বৃহস্পতিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

চার নেতার ১১ খুনি লাপাত্তা

মির্জা মেহেদী তমাল

চার নেতার ১১ খুনি লাপাত্তা

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সংগঠক জাতীয় চার নেতার ১১ খুনি লাপাত্তা। ফাঁসি ও যাবজ্জীবন দণ্ড মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা। তবে তারা কোথায় কী অবস্থায় রয়েছে সুনির্দিষ্টভাবে জানা নেই সংশ্লিষ্টদের। শেষ পর্যন্ত তাদের দণ্ড আদৌ কার্যকর হবে কিনা, এ নিয়ে নিয়ে সংশয়-সন্দেহ রয়েছে জনমনে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর ৩ নভেম্বর  ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী অবস্থায় হত্যা করা হয় তার অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে। জেলখানার নিরাপদ আশ্রয়ে এ ধরনের বর্বর হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। জাতির ইতিহাসে এ দিনটি আরেক শোকাবহ ও কলঙ্কময় দিন। অথচ জাতীয় এই চার নেতার ঘাতকরা দিব্যি বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের খোঁজ পাচ্ছে না বাংলাদেশের পুলিশ। তবে পুলিশ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আসামিদের খোঁজ পেতে ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করা আছে।  জেলহত্যার পলাতক এই আসামিরা হলো— মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও এল ডি দফাদার আবুল হাসেম মৃধা এবং যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এমএইচএম বি নূর চৌধুরী, এ এম রাশেদ চৌধুরী, আহমদ শরিফুল হোসেন, আবদুল মাজেদ, মো. কিসমত হোসেন ও নাজমুল হোসেন আনসার।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের পরপর লালবাগ থানায় মামলা দায়ের হলেও তদন্ত এগোয়নি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর অবশেষে ১৯৯৮ সালের ১৫ অক্টোবর আসামি ২৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. মতিউর রহমান এ মামলার রায় দেন। এতে রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও এল ডি দফাদার আবুল হাসেম মৃধাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তবে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হলে ২০০৮ সালে হাইকোর্ট মোসলেমের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে মারফত আলী ও হাশেম মৃধাকে খালাস দেয়।

আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন (লিভ টু আপিল) করা হয়। ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল আবেদন মঞ্জুর করে। হাইকোর্ট ফাঁসির তিন আসামির মধ্যে শুধু দুজনকে খালাস দেওয়ায় রায়ের ওই অংশটির বিরুদ্ধে আপিল করেছিল রাষ্ট্রপক্ষ। পলাতক আসামিদের পক্ষে আপিলের কোনো আবেদন করা হয়নি। ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল ফাঁসির তিন আসামির নিম্ন আদালতের রায় বহাল রেখে আপিলের রায় দেয় সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। বেঞ্চের অন্য বিচারকরা হলেন— বিচারপতি এস কে সিনহা, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি মো. ইমান আলী। ‘রাষ্ট্রপক্ষের আপিল মঞ্জুর এবং নিম্ন আদালতের রায় বহাল’ এজলাসে বসে এক কথায় রায় ঘোষণা করেছিল আদালত। রায় ঘোষণার আড়াই বছরের বেশি সময় পর গত বছর ১ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ২৩৫ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে। যাতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত দুই আসামিকে খালাস দিয়ে হাইকোর্ট আইন প্রয়োগে ভুল করেছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রায়ের মূল অংশ লেখেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনসহ চার বিচারক তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন। বিচারপতি নাজমুন আরার রায়ে বলা হয়, এই মামলায় পর্যাপ্ত প্রমাণ রয়েছে যে, ২ নভেম্বর রাতে রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের সঙ্গে এই দুই আসামি কারাগারে ঢুকেছিল। তাদের সঙ্গে আরও দুজন সামরিক বাহিনীর লোক ছিল। তারা সেখানে তাদের আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা আওয়ামী লীগের চার নেতাকে হত্যা করে। এ মামলায় বিচারিক আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় সেনা কর্মকর্তা খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, বজলুল হুদা, এম এইচ এম বি নূর চৌধুরী, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, এ এম রাশেদ চৌধুরী, আহমদ শরিফুল হোসেন, আবদুল মাজেদ, মো. কিসমত হোসেন, নাজমুল হোসেন আনসার, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানকে। ফারুক, শাহরিয়ার রশিদ, বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিনকেও খালাস দিয়েছিল হাইকোর্ট।

তবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় এই চারজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। অন্যরা পলাতক। এদের মধ্যে মেজর আহমদ শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন মো. কিসমত হাশেম ও ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন আনসার ছাড়া বাকিরা বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত। তারা এখনো পলাতক। নিম্ন আদালতের রায়ে খালাস পান বিএনপি নেতা প্রয়াত কে এম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, সেনা কর্মকর্তা মো. খায়রুজ্জামান ও আজিজ পাশা।

সর্বশেষ খবর