রবিবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

৭ নভেম্বর জাসদের অতি উৎসাহী দুঃসাহসী কাজ

নিজস্ব প্রতিবেদক

৭ নভেম্বর জাসদের অতি উৎসাহী দুঃসাহসী কাজ

কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম

কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীরবিক্রম বলেছেন, ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর জাসদের অপরিকল্পিত, অপরিপক্ব ও অতি উৎসাহজনিত দুঃসাহসিক একটি চরম ব্যর্থ উদ্যোগ। এতে শুধু যে তাদের বহুদিনের লালিত বাসনা বানচালই হয়েছে তাই নয়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় জিয়াউর রহমানের অধিষ্ঠিত হওয়ার পথ সুগম করে দিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে উচ্চাভিলাষী ও তীক্ষ বুদ্ধি জিয়া অন্যের সৃষ্ট সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিলেন মাত্র। এ ছিল ভাগ্যের এক নির্মম পরিহাস। জাফর ইমাম বীরবিক্রম গতকাল ধানমন্ডিতে তার বাসভবনে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে এক আলাপচারিতায় এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বিপরীত মূল্যায়নে দেখা যাবে যে, জিয়াকে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্ত না করে জাসদ যদি তাদের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আরও কিছুদিন পরে লাগাতার হরতাল চালু রেখে ৭ নভেম্বরের মতো অন্য কোনো দিনে সৈনিক সংস্থার বিপ্লবের পাশাপাশি মিছিলে মিছিলে ঢাকা নগরী প্রকম্পিত করতে পারত তাহলে তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। জাফর ইমাম বলেন, দুর্ভাগ্যজনক ও কলঙ্কিত জেল হত্যাকাণ্ড মূল্যায়নে দেখা যায়, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থান এ দেশের ইতিহাসে একটি political turning point হিসেবে যুগ যুগ ধরে বিবেচিত হবে। কারণ খন্দকার মোশতাকরা ষড়যন্ত্রের যে নীলনকশা অনুযায়ী ১৫ আগস্ট নির্মম হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল, জেলহত্যা সেই নীলনকশারই অংশ। তাদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনা ধূলিসাৎ করে পাকিস্তানি ভাবধারায় দেশকে ফিরিয়ে নেওয়া। এ ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ভেদ করে স্বাধীনতার পক্ষশক্তির জন্য এক নতুন দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছিল ৩ নভেম্বর। ৩ নভেম্বরের মূল লক্ষ্যই ছিল খুনি চক্রকে অপসারণ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত করা। মোশতাককে অপসারণ করে বিচারপতি আবু সাদত মো. সায়েমকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হয়েছিল। নতুন রাষ্ট্রপতি সায়েম সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছিলেন। জাফর ইমাম বলেন, ৩ নভেম্বর সংঘটিত না হলে হয়তো ৭ নভেম্বর হতো না। হলেও এর পরিণতি হতো খুব করুণ ও ভয়াবহ।

রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েম সংসদ বাতিল করে দেশবাসীকে নতুন নির্বাচনের আশ্বাস দিলেন। এর ফলে দেশে দুই দিন ধরে যেসব জল্পনা-কল্পনা চলছিল তার অবসান ঘটল। ব্রিগেডিয়ার খালেদের এত সতর্কতা সত্ত্বেও রাজনৈতিক মহল বলাবলি করছিল যে, খালেদ আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং তিনি ক্ষমতায় থাকলে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে। তবে, নতুন নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি থাকায় এ ব্যাপারে জনমনে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। সেনাবাহিনীতে পরিস্থিতি পুরোপুরি খালেদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল। ইংরেজিতে একটি কথা আছে Defeat is an orphan. ৭ নভেম্বরের কারণে খালেদকে ‘ব্যর্থ অভ্যুত্থানের নায়ক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হলো ইতিহাসে। আমি আগেও বলেছি, ৭ নভেম্বরের ঘটনা ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পাল্টা কিছু নয়। অনেক আগ থেকেই সেনাবাহিনীর ইউনিটগুলোয় কয়েকজন করে প্রতিনিধি গোপন সৈনিক সংস্থার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। তাদের হাইকমান্ডের নির্দেশে ৭ নভেম্বরকে তারা বেছে নিয়েছিল সঠিক সময় হিসেবে। ৬ নভেম্বর রাতে এলিফ্যান্ট রোডে কর্নেল তাহেরের ভাই আনোয়ার হোসেনের বাসায় জাসদ, গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গোপন বৈঠক করে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মোটামুটি তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। ঢাকার সর্বত্র তারা একটি লিফলেট বিতরণ করে। সন্ধ্যায় ওই লিফলেট বিতরণের পর ঢাকায় বিভিন্ন মহলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে, ‘কিছু একটা হতে যাচ্ছে’। পাশাপাশি সেনাবাহিনীতেও সৈনিক সংস্থার একটা ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছিল। তাদের সিদ্ধান্ত ছিল, সেনানিবাসে রাত ১২টা ১ মিনিটে সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বে Motivated সৈনিকরা ফাঁকা গুলি ছুড়তে শুরু করবে। এটাই হবে জাসদ ও গণবাহিনীর জন্য সংকেত। সঙ্গে সঙ্গে তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল বের করবে। আদমজী থেকে একটা বড় মিছিল বের করার পরিকল্পনা ছিল। সেনানিবাসে সৈনিকদের বিদ্রোহের সমর্থনে বাইরে মিছিল চলবে এবং জনসমর্থন পক্ষে আনার প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হবে। ১২টা ১ মিনিটে ঢাকা সেনানিবাসে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল, একই সময়ে বাইরের পরিকল্পনা অনুযায়ী যে মিছিলটি ঢাকায় হয়েছিল তা আকারে খুব একটা বড় ছিল না। সকালের দিকে যদিও খণ্ড খণ্ড মিছিল রাস্তায় ছিল, সে মিছিলগুলোর মধ্যে জাসদ ছাড়াও অনেক আওয়ামী লীগবিরোধী লোক ছিল।

৪ নভেম্বর খালেদের বৃদ্ধা মাকে সামনে রেখে রাশেদ মোশাররফ ও মোস্তফা মহসীন মন্টুর নেতৃত্বে যে মৌনমিছিল বেরিয়েছিল অনেকে পরবর্তীতে এই মিছিল খালেদের ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের সমর্থনে ছিল বলে অপপ্রচার করে। ৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় ৩ নভেম্বর কেন্দ্র করে যে লিফলেট প্রচারিত হয়, এতে জনগণের মধ্যে নতুনভাবে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। ঢাকা সেনানিবাসে সিপাহিদের বিদ্রোহের ঘটনার সমর্থনে যদি জাসদ পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রাজধানীতে ব্যাপক মিছিল ও সমাবেশের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমর্থন জোরদার করতে পারত, তাহলে জিয়াউর রহমান লংমার্চের পরিকল্পনা বাতিলসহ আরও অনেক সিদ্ধান্ত নিতে সংকটে পড়তেন। জনগণের মধ্যে জাসদের সমর্থন ব্যাপক ছিল না এবং পরিস্থিতিরও সদ্ব্যবহার সঠিকভাবে পরিকল্পনা মোতাবেক না করতে পারায় সকাল ১০টা-১১টার মধ্যে জাসদের প্রয়াস ব্যর্থ হয়ে যায়।

সর্বশেষ খবর