সোমবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
৭ নভেম্বরের অজানা কাহিনী

৩ নভেম্বরের মিছিল ছিল পূর্ব নির্ধারিত

কর্নেল জাফর ইমাম (অব.)

অভ্যুত্থানের অনেক আগেই ৩ নভেম্বরের মৌন মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। তাই এই মিছিলের সঙ্গে খালেদ মোশাররফের কোনো সম্পর্ক ছিল না। ঢাকা সেনানিবাসের  ভিতরে ৬ নভেম্বর মধ্যরাত থেকে ৭ নভেম্বর সকাল ১০টা-১১টা পর্যন্ত সৈনিক সংস্থার ‘সিপাহি সিপাহি ভাই ভাই অফিসারের রক্ত চাই’ স্লোগান সহকারে অফিসার হত্যা এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। কর্নেল তাহের সেনানিবাসের বাইরে থেকে সৈনিক সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিল। যদিও অধিকাংশ সিপাহি এর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছিল, কিন্তু বেশির ভাগ সৈনিক আসল পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য জানত না। অনেকেই অফিসার হত্যাকে সমর্থন না করে সেনাবাহিনীতে Chain of Command ফিরে আসুক সেটাই চেয়েছিল। অফিসার হত্যা অব্যাহত রেখে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যেন না আসে সে জন্য জাসদের একটি অংশ ছাড়াও দেশি-বিদেশি আরও একটি চক্র জড়িত ছিল বলে অনেকের অভিযোগ রয়েছে। জাসদের একটি অংশও এই ব্যাপারটিকে সমর্থন করছিল না। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে কর্নেল তাহেরদের পরামর্শক্রমে সৈনিক সংস্থার সদস্যরা অন্যান্য জিয়া-ভক্ত সৈনিকদের নিয়ে জিয়াকে গৃহবন্দী থেকে উদ্ধার করে দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্টে অর্থাৎ কর্নেল রশিদের ইউনিটে নিয়ে আসে। সৈনিক সংস্থা ও জাসদ চেয়েছিল, সে মুহূর্তে যেহেতু জিয়ার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে তাকে সামনে রেখে সিপাহিদের একতাকে তাদের পক্ষে আরও দৃঢ় করা এবং তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। জিয়া বিষয়টা ভালোভাবে বুঝে ওঠার জন্য বিশেষ করে সেনাবাহিনীর কমান্ড ঠিক করে আনার লক্ষ্যে প্রথম কয়েক ঘণ্টার জন্য সব ব্যাপারে জাসদের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেন। ঢাকা সেনানিবাসে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগের পাশাপাশি জিয়া জাসদের রব, জলিলসহ অন্যান্যদের জেল থেকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন এবং ১২টার মধ্যে জিয়া সেনাবাহিনীর  Chain of Command  মোটামুটিভাবে ঠিক করে ঢাকা সেনানিবাসে শৃঙ্খলা অনেকটা ফিরিয়ে আনেন। এককথায় সেনানিবাসের পরিস্থিতি জিয়া নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। ঢাকায় তখন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জাসদের লংমার্চের প্রস্তুতি চলছিল। খন্দকার মোশতাক সেনাবাহিনীর ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে বসে জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে সব কিছু তার পক্ষে হচ্ছে, জিয়া তো তার সেনাপ্রধানই ছিলেন। তাই তিনি যেহেতু সেনানিবাসকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন, জিয়া তার অনুগত থাকবেন। সেনাবাহিনীর সৈন্য বোঝাই কয়েকটি ট্রাক বহর মিছিল করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যায়। জিয়ার ১২টায় লংমার্চে যোগদানের জন্য শহীদ মিনারে আসার কথা ছিল। তিনি আর আসলেন না। আর্মির যেই অংশটি সেই সময়ে শহীদ মিনারে গিয়েছিল তারা লংমার্চের উদ্দেশ্যে সমবেত জাসদ কর্মী ও নেতৃবৃন্দকে আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে মারধর করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। জাসদ এর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত জিয়া এবং তাহেরের নামে স্লোগান দিচ্ছিল। শহীদ মিনারের আশপাশে মোশতাকদের কিছু পোস্টার ও ছবি ছিল। জাসদের উত্তেজিত নেতা-কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার পর সেগুলো ছিঁড়ে ফেলে দেয় ও মোশতাকের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে। এর আগে কর্নেল তাহের রেডিও স্টেশনে এসেছিলেন ভাষণ দেওয়ার জন্য। সেখানে তখন মোশতাকও উপস্থিত ছিলেন। তাহের বা মোশতাক কাউকেই ভাষণ দিতে দেওয়া হলো না। জিয়া বেলা ১১টার পর জাসদের সঙ্গে তার পূর্ব প্রতিশ্রুতি মোতাবেক আর কোনো সমঝোতা রক্ষা করছিলেন না এবং আরও পরবর্তীতে একের পর এক জাসদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাকশনে গিয়েছিলেন। সে জন্য জাসদ জিয়াকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আখ্যায়িত করে। জিয়াও ১১টার পর লংমার্চে না গিয়ে প্রশাসন ও বিভিন্ন মহলের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। বিশেষ করে আমেরিকান দূতাবাসের সঙ্গে লংমার্চের নির্ধারিত সময় বেলা ১২টার আগেই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সেরে নিয়েছিলেন। জিয়া লংমার্চে না গিয়ে কৌশলে সবকিছু নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে বিচারপতি সায়েমকে প্রেসিডেন্ট ও Cheif Martial Law Administrator  রেখে জিয়া নিজে সেনাপ্রধান ও Deputy Cheif Martial Law Administration হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই দিনের এবং সে সময়কার বিরাজমান পরিস্থিতিতে বৃহত্তম জাতীয় স্বার্থে জিয়ার এর বিকল্প হয়তো আর কিছু করণীয় ছিল না। জিয়ার কৌশলগত এই ভূমিকার বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে তখন কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছিল না। সবাই আশা পোষণ করেছিল, জিয়া নতুন নির্বাচন দিয়ে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া পুনরায় চালু করবেন। ৭ নভেম্বরের প্রথম পর্বে সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বে জিয়াকে গৃহবন্দী থেকে দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্টে নিয়ে আসা, জিয়ার সঙ্গে জাসদের সমঝোতা, পরে সমঝোতা ভেঙে এবং সর্বোপরি দ্বিতীয় পর্বে জাসদ ও মোশতাক গংদের বাদ দিয়ে ব্যক্তি সমর্থনে ও কৌশলে এগিয়ে যাওয়ার কারণে ৭ নভেম্বর বিপ্লব দিবস হিসেবে সঠিক মূল্যায়ন অনেকের কাছে এখনো বিতর্কিত। আমি ৬ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা ও অন্যান্য সহকর্মীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে Flying Club এর একটি Cessna Aricraft করে রংপুরে আমার ইউনিটে ফিরে যাই। যাওয়ার সময় খালেদ আমাকে বলেছিলেন, রংপুর ব্রিগেড যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে। রংপুরে অবস্থানরত রক্ষীবাহিনীর ইউনিটগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে, প্রয়োজনে ইউনিট নিয়ে ঢাকার দিকে আসতে হতে পারে। সর্বশেষ বললেন, ‘যশোর ব্রিগেডের দিকে নজর রাখবে এবং ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে।’ আমার যুদ্ধকালীন ইউনিট ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ইতিমধ্যে রংপুর থেকে ঢাকায় এসে শেরেবাংলা নগরে অবস্থান করছিল। এই ইউনিট যেহেতু যুদ্ধ চলাকালীন আমার অধিনায়কত্বে ‘কে’ ফোর্সের অধীনে ছিল সে কারণে এই ইউনিটের ওপর খালেদের আস্থা ছিল অনেক বেশি। ৬ নভেম্বর রাতে ওই ভয়াবহ পরিস্থিতির সময় খালেদ, রক্ষীবাহিনীর প্রধান নুরুজ্জামান, কর্নেল হায়দার ও কর্নেল হুদা দশম বেঙ্গলে আশ্রয় নেওয়ার উদ্দেশে কাঁঠালবাগান খালেদের এক আত্মীয়ের বাসা হয়ে শেরেবাংলা নগরের দিকে যাত্রা শুরু করেন। আসাদগেট পৌঁছার পর ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান সাভার অভিমুখে চলে যান, বাকি তিনজন দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে এসে উপস্থিত হন। সারারাত ধরে খালেদ-হুদাদের সঙ্গে জিয়া-ভক্ত অফিসারদের কথা কাটাকাটি চলছিল। যুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তান আর্টিলারি সেলে কপালে আঘাতপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ শান্তভাবে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন। তিনি এক বসায় শেষ রাত পর্যন্ত প্রায় ২-৩ প্যাকেট সিগারেট শেষ করলেন। রংপুর থেকে ঢাকা আসা এই দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সৈনিকদের কোনো বিদ্রোহ ছিল না। মাত্র কিছুসংখ্যক অফিসার ও সৈনিকের মধ্যে উপরের ইঙ্গিতে কিছুটা উত্তেজনা ছিল। বড় ধরনের কোনো ষড়যন্ত্র ও ঢাকা সেনানিবাস থেকে কারও যোগসাজশ ছাড়া এই সুপরিকল্পিত নির্মম হত্যাকাণ্ড ভোর রাতে সংঘটিত হতে পারে না। বিদ্রোহীদের হাতে যদি খালেদ-হুদা-হায়দার নিহত হতেন তাহলে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ও ব্যবস্থাপনায় তাদের লাশ ঢাকা সিএমএইচে এনে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ করা, তাদের আত্মীয়-স্বজনকে খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় খবর পৌঁছানো, এমনকি কর্নেল হুদার স্ত্রীকে রংপুর থেকে আনার জন্য হেলিকপ্টার পাঠানো ইত্যাদি ওই উত্তেজিত পরিস্থিতিতে সম্ভব হতো না। সেদিন খুব সুপরিকল্পিতভাবে এও প্রচার করা হয়েছিল যে, খালেদ ইন্ডিয়ান এজেন্ট ছিল এবং তার কাছে ইন্ডিয়ান টাকা পাওয়া  গেছে যা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ প্রচার শুধু খালেদের বিরুদ্ধে ছিল না, পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেও ছিল। অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হত্যাকাণ্ডের বিচারের পাশাপাশি এই বীর সেক্টর কমান্ডার মে. জেনারেল খালেদ, কর্নেল হুদা ও কর্নেল হায়দার হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত এবং হত্যাকাণ্ডের রহস্য জাতির জানার অধিকার রয়েছে।

সর্বশেষ খবর