সোমবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
৭ নভেম্বরের অজানা কাহিনী

বিপ্লব প্রত্যাশীরা দীর্ঘদিন ধরে পেছনে যুক্ত ছিলেন

ড. আনোয়ার হোসেন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেছেন, ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর দিনটিতে প্রকৃতই প্রতিবিপ্লব জয়ী হয়েছিল। জাসদ ও কর্নেল তাহেরের  বিপ্লবী প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। এখন একেক রাজনৈতিক সংগঠন একেকভাবে ওই দিনটিকে অভিহিত করছে। তবে ৩৯ বছর আগের ওই জটিল, উত্তাল সময়টিকে নির্মোহভাবে মূল্যায়ন করা হবে, এটাই আমরা চাইব। ড. আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আরও বলেন, একে খোন্দকারের মতো ব্যক্তিরা আমাদের মুক্তি সংগ্রামকে পেছনের দীর্ঘ ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে কেবল একটি ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইছেন। মনে রাখতে হবে যে ৭ নভেম্বরের পেছনেও দেশের বিপ্লবপ্রত্যাশী মানুষ দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত ছিলেন, যার নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম। তিনি জয়যুক্ত হতে পারেননি, কিন্তু কোনো আপস না করে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে আপন অঙ্গীকার ও বিপ্লবী অবস্থান অক্ষত রেখেছেন। এ অভ্যুত্থান সফল পরিণতি লাভ না করায় জাসদ এবং তার নেতৃত্বকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। প্রতিবিপ্লবীরা জয়ী হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি দীর্ঘ সময় ধরে দেশ শাসনের সুযোগ পায় এবং আর্থ-সামাজিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ে। অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, জাসদের সার্বিক কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে ৭ নভেম্বর প্রসঙ্গে আমরা এখন বলতে পারি যে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে জাসদ কার্যত বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতাকেই মুখ্য করে ফেলেছিল। তার ফলে যে ক্ষতি হলো সেটা হচ্ছে জাতির জনকের হত্যার মধ্য দিয়ে জাসদ রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতাই যেন হারিয়ে যায়। তিন বছরের নিরলস কার্যক্রম ও হাজার হাজার নেতা-কর্মীর জীবনদানের মধ্য দিয়ে জাসদ একটি সংগঠন হিসেবে যা কিছু অর্জন করেছিল তা হারিয়ে যেতে থাকে। ১৫ আগস্টের পর তারা চলে যেতে থাকে গৌণ অবস্থানে। ক্ষমতার রাজনীতির কেন্দ্রে চলে আসে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি। তিনি বলেন, এ কথাও  মনে রাখতে হবে যে, প্রকাশ্য রাজনৈতিক তত্পরতার সুযোগ না থাকায় জাসদ সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়ে তার বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারেনি। তবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর চীনপন্থি হিসেবে পরিচিত কয়েকটি দল যে ভুল করেছিল, জাসদ সেটা করেনি। ওই শক্তিগুলো বঙ্গবন্ধুর ঘাতক মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করতে থাকে। কিন্তু জাসদ প্রথম থেকেই খন্দকার মোশতাকের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। ১৫ আগস্টের আগে জাসদ নেতৃত্ব ধারণা করছিলেন যে ১৯৭৬ সাল নাগাদ দেশে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সামাজিক বিপ্লবের প্রথম ধাপটি অতিক্রম করার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। কিন্তু চরম দক্ষিণপন্থি শক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে নেওয়ায় নতুন কর্তব্য উপস্থিত হয় তাদের সামনে। করণীয় নির্ধারণে জাসদের মধ্যে দুটি মত দেখা দেয়। এক পক্ষ মনে করে যে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং ধীরেসুস্থে রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করাই শ্রেয়। অন্যদিকে কর্নেল তাহের মনে করেন, রাষ্ট্রে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এখন একমাত্র জাসদের পক্ষেই সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা সম্ভব। তিনি দৃঢ়মত ব্যক্ত করে বলেন যে জাসদ এ সুযোগ কাজে না লাগালে দক্ষিণপন্থিদের অবস্থান সংহত হবে এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি  হবে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি ওই দেশটিতে সেনাবাহিনী সুহার্তের নেতৃত্বে কয়েক লাখ বামপন্থি ও কমিউনিস্টকে হত্যা করেছিল। বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে দেওয়া যায় না। অফিসারদের যুক্ত করলে অভ্যুত্থান সফল হতো? এমন প্রশ্নে ড. আনোয়ার বলেন, সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অধস্তন সদস্য অর্থাৎ প্রধানত সিপাহিদের মধ্যে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গড়ে তুললেও অফিসারদের মধ্যেও জাসদ একটি গোপন সংগঠন গড়ে তুলতে পেরেছিল কর্নেল তাহেরের তত্ত্বাবধানে। এর প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মেজর জিয়াউদ্দিন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে নভেম্বরের সেই উত্তাল প্রথম সপ্তাহে তিনি ছিলেন ঢাকা থেকে বেশ দূরে খুলনায়। তার অনুপস্থিতির কারণে সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানে অফিসারদের সাংগঠনিকভাবে যুক্ত করা যায়নি। জিয়ার মুক্তিকে গুরুত্ব দেওয়া হলো কেন? জীবনাশঙ্কায় থাকা জিয়াউর রহমানের মুক্তির বিষয়টিকে অভ্যুত্থানের একটি লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেছিলেন তাহের। কথা ছিল যে অভ্যুত্থানকারী সৈনিকেরা জিয়াকে মুক্ত করে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে নিয়ে আসবেন এবং তার সঙ্গে রাজনৈতিক বোঝাপড়া হবে। আরেকটি লক্ষ্য ছিল অস্ত্রাগারের অস্ত্র অভ্যুত্থানি সিপাহিরা সংগঠিত  শ্রমিক ও ছাত্রদের হাতে দেবে। এর মধ্য দিয়েই অনেকটা সোভিয়েত মডেলে সৈনিক ও শ্রমিকদের অভ্যুত্থান সংঘটিত হবে। অভ্যুত্থানের কিছু লক্ষ্য প্রাথমিকভাবে অর্জিত হলেও দুটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যত্যয় ঘটে — এক. জিয়াকে মুক্ত করা হলেও সিপাহিরা তাকে বাসায় রেখেই ক্যান্টনমেন্টের বাইরে তাহেরের কাছে ফিরে আসে। অফিসারদের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান হলে এটা ঘটত না। দুই. জাসদের শ্রমিক ও ছাত্র সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা কর্তব্য পালনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেন। ফলে সৈনিকরা দলে দলে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে এলেও অস্ত্রসজ্জিত করার মতো শ্রমিক ও ছাত্রদের তারা পায়নি। বিজয়ী হিসেবে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা হাতে নিয়ে বিভিন্ন দেশে প্রতিবিপ্লবীরা যে পথ অনুসরণ করে তিনিও তার অন্যথা করেননি। অভ্যুত্থানের নায়ক কর্নেল তাহের এবং ৭ নভেম্বরের পর যেসব জাসদ নেতাকে তিনি মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন তাদের ফের গ্রেফতার করলেন। স্বল্প সময়ের মধ্যেই গোপন ট্রাইব্যুনালের বিচারের নামে প্রহসন করে তিনি কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেন। জাসদের শীর্ষ নেতাদের দীর্ঘমেয়াদে দেওয়া হয় কারাদণ্ড। ৭ নভেম্বরের ঘটনা থেকে নতুন প্রজন্মের কি কিছু শিক্ষণীয় আছে? এমন প্রশ্নে ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ওই দিনের ঘটনায় ইতিবাচক কিছু আছে কিনা তা বিবেচনার ভার রাজনৈতিক ও সমাজ বিশ্লেষকদের হাতে ছেড়ে দিয়ে ভবিষ্যৎ বিপ্লবপ্রত্যাশী নতুন প্রজন্মকে আহ্বান জানাব তাদের লক্ষ্য নির্ধারণে ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থান থেকে ইতিবাচক শিক্ষা যেন তারা নেয়। মনে রাখতে হবে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে যেসব অসঙ্গতির কারণে নভেম্বর অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল, তার অনেককিছুই এখনো বর্তমান। শুধু একটি সর্বব্যাপী বিপ্লবী অভ্যুত্থান ছাড়া সংকট সমাধান হবে না। তা শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা পৃথিবীজুড়েই।

সর্বশেষ খবর