বৃহস্পতিবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিশ্বকে চমকে ট্রাম্পের জয়

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

বিশ্বকে চমকে ট্রাম্পের জয়

জয়ী হওয়ার পর সমর্থকদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প —এএফপি

বাংলাদেশে গতকাল সকাল থেকেই টিভি স্ক্রিনে প্রচার হতে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল। তখন সে দেশে রাত। চলছে ভোট গণনা। একের পর এক আসছে ফল। চলছে উৎসবমুখর ‘ইলেকশন নাইট’। বিশ্বের বাঘা বাঘা সব গণমাধ্যমের জরিপে প্রচার হচ্ছে ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের নিশ্চিত জয়ের আভাস। ফল প্রচারের শুরুর দিকে কিছুক্ষণ এগিয়েও ছিলেন তিনি। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরই হিলারিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যান নানা বিতর্কের জন্ম দেওয়া রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। তখনো বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জরিপগুলোর ফলগুলো রীতিমতো হিলারির পক্ষে গ্যারান্টি দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু হিলারি আর একবারের জন্যও পেছনে ফেলতে পারেননি ট্রাম্পকে। না সেটা ইলেকটোরাল ভোটে, না পপুলার ভোটে। হিলারির দল পারেনি কংগ্রেসের (মার্কিন সংসদ) কোনো কক্ষেই। সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদ উভয় ক্ষেত্রেই একচ্ছত্র আধিপত্য দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্টের পদ বাগিয়ে নিয়েছেন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারাভিযান জুড়ে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী ঘৃণা কুড়ানো ট্রাম্পকে বলা হচ্ছিল ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী। এমন ‘পাগলাটে’ ব্যক্তিকে যে যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবেন এমনটা ভাবতেই পারেননি ঝানু নির্বাচনী পর্যবেক্ষকরাও। সব জরিপ ও বিশ্লেষণ উল্টে দিয়ে ট্রাম্পের এ চমকপূর্ণ জয়ে তাই বিস্মিত বিশ্বের খ্যাতনামা রাজনীতিকরাও। মাত্র দেড় বছর আগে প্রার্থিতার ঘোষণা দিয়ে রাজনীতিতে আসা ট্রাম্প যেভাবে রাজনৈতিক রীতিনীতি দুমড়ে মুচড়ে দিলেন তাতে সবাই হতবাক। বলতে গেলে, ট্রাম্প এখন পরিণত হয়েছেন এক বিস্ময়ে। ফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই এ বিস্ময়মূলক প্রতিক্রিয়া ফুটে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে জাপান, অস্ট্রেলিয়া আফ্রিকার গণমাধ্যমগুলোর অনলাইন সংস্করণগুলোতে। বিবিসি বলছে, ট্রাম্প মূলত তার পাঁচ কৌশলের কারণে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন এবং এর কোনো কৌশলই অন্যরা ধরতে পারেনি। বিজয়োত্তর ভাষণে ট্রাম্প বলেছেন তিনি হবেন সব আমেরিকানের প্রেসিডেন্ট। বলেছেন, এবং তা হওয়াই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন নির্বাচনী সংস্থার তথ্যমতে, আগামী চার বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতে প্রায় ২২ কোটি নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে প্রায় ৫৪ শতাংশ ভোটার নিজেদের ভোট প্রদান করেছেন। প্রেসিডেন্ট পদ নিশ্চিত করতে এ নির্বাচনে ৫০ রাজ্যে ৫৩৮টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের মধ্যে প্রয়োজন ছিল ২৭০ ভোট। সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত ঘোষিত ফলাফলে ট্রাম্প পেয়েছেন ২৮৯টি ইলেকটোরাল ভোট। আর হিলারি পেয়েছেন ২১৮টি ইলেকটোরাল ভোট। জনপ্রিয়তার হিসাব কষা পপুলার ভোটের ক্ষেত্রেও এগিয়ে গেছেন ট্রাম্প। তিনি পেয়েছেন ৫ কোটি ৮৫ লাখ ৮ হাজার ৬১৪ ভোট অর্থাৎ মোট ভোটের ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ। হিলারি ক্লিনটন পেয়েছেন ৫ কোটি ৮২ লাখ ১৬ হাজার ৯০৩ ভোট। মঙ্গলবার প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়াও কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ আসনের সব কটিতে ও উচ্চকক্ষ সিনেটের ১০০ আসনের মধ্যে ৩৪ আসনে নির্বাচন হয়। সেখানেও আধিপত্য রিপাবলিকানদের। প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ পেতে যেখানে প্রয়োজন ২১৮টি আসন সেখানে ট্রাম্পের দল রিপাবলিকানরা পেয়েছে ২৩৫টি আসন, হিলারি দল ডেমোক্রেটরা পেয়েছে ১৯১ আসন। আর সিনেটে রিপাবলিকানরা ৫১ আসন পেয়েছে। এখানে ডেমোক্রেটরা পেয়েছে ৪৭ আসন। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থাগুলোর প্রচারিত প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে, সব জরিপে এগিয়ে থাকায় হিলারির প্রচারণা সদর দফতর ভোট চলার সময় সারাক্ষণই ছিল উৎসবমুখর। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ফল প্রকাশের আগেই পরাজয় বুঝতে পেরে হিলারির সমর্থকরা মুষড়ে পড়ে। কান্নায়ও ভেঙে পড়েন অনেকে। রাতে কথা বলেননি হিলারি ক্লিনটন নিজেও। অবশ্য ফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্রামে যাওয়ার আগে হিলারি ফোনে অভিনন্দন জানান বিজয়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। ট্রাম্পও অভিনন্দন জানান হিলারিকে ‘অত্যন্ত কঠিন এক নির্বাচনী লড়াই চালানোর জন্য’। জানা যায়, ট্রাম্পের জয়ের চমকের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে। হতবাক হয়ে যাওয়া বিশ্ব পুঁজিবারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তৈরি হয় শঙ্কা। শুরু হয় ব্যাপক দরপতন। বড় বড় স্টক এক্সচেঞ্জগুলো হয় নিম্নমুখী। এই অস্থিরতা হয় দীর্ঘ। কারণ হিলারি ক্লিনটন জয়ী হচ্ছেন এমন আভাসে নির্বাচনের আগে আগে চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল বিশ্বের বাজারগুলো। চমকের ধকল কাটিয়ে উঠতে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠক ডেকেছে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান তার শীর্ষ অর্থনৈতিক কর্মকর্তাদের নিয়ে বসেছে জরুরি বৈঠকে।

ট্রাম্পের জয়ের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত জেরার্ড আরাউড টুইটারে লিখেছেন, ‘ব্রেক্সিট ও সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর এখন সবই সম্ভব। আমাদের চোখ বুজে আসার আগেই যে এই পৃথিবী ধ্বংস হচ্ছে তা নিশ্চিত’। সুইডেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কার্ল বিল্ড লিখেছেন, ‘এই বছর হলো পশ্চিমাদের দ্বিতীয় দফায় ধ্বংসের বছর।’ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরুর পর জার্মান পত্রিকা দে ওয়েল্ট , ‘একটি পুরনো পোস্টারে ট্রাম্পের মাথা বসিয়ে পুনরায় প্রকাশ করে।’ জাপানের এনএইচকে বলেছে, ‘ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে জাপানসহ অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।’ এখন প্রশ্ন উঠেছে, এত সমালোচনা এত সতর্কতার পরও কীভাবে সম্ভব হলো ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হয়ে যাওয়া? বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রার্থিতার জন্য এক বছর আগে প্রচারণা শুরুর পর খুব কম মানুষই ভেবেছিলেন যে, ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবেন। বেশিরভাগ মানুষের ধারণা ছিল ট্রাম্প কোনো প্রাইমারিতে জিততে পারবেন না। এমনকি রিপাবলিকান পার্টি থেকে ট্রাম্প মনোনয়ন পাবেন না বলেই নিশ্চিত ছিল বেশিরভাগ মানুষ। বিবিসি বলছে, নির্বাচনে জিততে ট্রাম্পের কৌশলগুলো অন্যদের ধারণার বাইরে ছিল। ট্রাম্পের পাঁচ কৌশল হলো— নিজের পক্ষে শ্বেতাঙ্গদের জোয়ার তোলা, বিতর্ক ও কেলেঙ্কারির পরেও নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকা, রাজনীতির বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকলেও কাউকে পাত্তা না দেওয়া, হিলারির ই-মেইল নিয়ে এফবিআইয়ের পরিচালক জেমস কোমির তত্পরতা এবং নিজের ওপর ট্রাম্পের আস্থা ও বিশ্বাস। এর মধ্যে শ্বেতাঙ্গদের প্রতি ট্রাম্পের চরম পক্ষপাতমূলক বক্তব্য সরাসরি আঘাত হেনেছে হিলারির দুর্গে। কলেজের দোরগোড়া না পেরনো শ্রমিক শ্রেণির সাদা ভোটারদের যারা এতদিন ডেমোক্রেটদের মূল ভরসা ছিল তারা দল বেঁধে ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে। এদের বেশিরভাগই গ্রামের মানুষ। তারা এতদিন কায়েমি শক্তির কাছে উপেক্ষিত হয়েছে বলে বোধ করেছে এবং উপকূলীয় অভিজাতদের পেছনে পড়েছিলেন। তারা নিজের পক্ষে ট্রাম্পের কাছ থেকে আওয়াজ শুনেছেন। তাই এতদিন শক্ত ঘাঁটি ভাবলেও ভোটের ময়দানে পতন হয়েছে হিলারি ক্লিনটনের।

প্রচারাভিযানে বারবার বিতর্কের মুখে পড়েও বিচলিত না হওয়ায় ট্রাম্প ভোটারদের কাছে বর্জনের পরিবর্তে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন বলেও মনে করছে বিবিসি। একের পর এক নারী কেলেঙ্কারি ও বিতর্ক এলেও ট্রাম্পের ব্যক্তিত্ব সেগুলোকে কাটাতে পেরেছে। রাজনীতির বাইরের মানুষ ট্রাম্প ডেমোক্রেটদের বিরুদ্ধে শুধু নয় নিজের দলে যারা ক্ষমতাসীন তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন এবং সবাইকে পরাস্ত করেছেন। প্রাইমারিতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো দলের সুপরিচিত অনেক নেতাকে তিনি বশ্যতা স্বীকার করাতে পেরেছেন। এমনকি হাউস স্পিকার থেকে শুরু করে দলে বাকি নেতাদেরও সহায়তা লাগেনি তার। বাস্তবে হয়তো তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার দৃঢ়তাই হয়তো তাকে জিতিয়েছে বলে মনে করছে বিবিসি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর