শুক্রবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ক্ষোভে উত্তাল যুক্তরাষ্ট্র

আলাদা হওয়ার দাবি ক্যালিফোর্নিয়ায়। বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি

প্রতিদিন ডেস্ক

ক্ষোভে উত্তাল যুক্তরাষ্ট্র

ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের পর তার প্রতি অনাস্থা এনে ক্যালিফোর্নিয়ায় বিক্ষোভ —এএফপি

নির্বাচিত হতে না হতেই বিক্ষোভের মুখে পড়েছেন নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘বিস্ময়কর’ বিজয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি শহরে সহিংস বিক্ষোভ হয়েছে। নিউইয়র্ক, শিকাগোসহ অন্তত সাতটি বড় শহরে ট্রাম্পবিরোধী এই বিক্ষোভ হয়। এদিকে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ চলাকালে ওয়াশিংটনের সিয়াটলে এক বন্দুকধারীর গুলিতে এক নারীসহ পাঁচজন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছে পুলিশ। বিক্ষোভকারীরা নির্বাচনী প্রচারাভিযানে ট্রাম্পের অভিবাসী, মুসলমান ও অন্যান্য গোষ্ঠীকে আক্রমণ করে দেওয়া বক্তব্যের সমালোচনা করে স্লোগান দিয়েছেন। মঙ্গলবার ট্রাম্পের জয় নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে সান ফ্রান্সিসকোর বে এলাকা, ওকল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ শুরু হয় বলে রয়টার্স জানিয়েছে।

বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন  দোকানের সামনে ভাঙচুর করে, টায়ারে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় তারা পুলিশের রায়ট কারের দিকে ঢিল ছুড়লে পুলিশও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে বলে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান। বুধবার ভোরে বার্কলে ও ওকল্যান্ড শহরে কয়েকশ মানুষ রাস্তায় নেমে ‘ট্রাম্প আমার প্রেসিডেন্ট নয়’ বলে স্লোগান দেয়। পিটসবার্গ, সিয়াটল, পোর্টল্যান্ড এবং ওরেতেও বিক্ষোভের খবর দিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস। এ ছাড়া পেনসিলভানিয়া থেকে ক্যালিফোর্নিয়া, ওরেগন থেকে ওয়াশিংটন স্টেট—সব জায়গায় শত শত মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছে বলে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো জানিয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ায় বিক্ষোভকারীরা একটি সড়কে ঢোকার সময় গাড়ির ধাক্কায় একজন আহত হন বলে স্থানীয় হাইওয়ে পেট্রোল জানিয়েছে। ওরেগনে বিক্ষোভকারীরা সড়ক অবরোধের পাশাপাশি রেল চলাচলেও বাধা দেয়। সেখানে ৩০০ বিক্ষোভকারী ‘ট্রাম্প আমার প্রেসিডেন্ট নয়’ স্লোগান দেয়। কাউকে কাউকে আমেরিকার পতাকায়ও আগুন দিতে দেখা যায়। বুধবার নিউইয়র্কে হাজারো বিক্ষোভকারী ট্রাম্প টাওয়ার এলাকার আশপাশজুড়ে বিক্ষোভ করে বলে রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানানো হয়। ম্যানহাটান মিডটাউনের ফিফথ এভিনিউয়ের ওই টাওয়ারেই বসবাস করেন ট্রাম্প। শতাধিক বিক্ষোভকারী ম্যানহাটান পার্কের কাছে একত্র হয়ে ট্রাম্পবিরোধী স্লোগান দিতে থাকেন। শিকাগোর ডাউনটাউনে প্রায় দুই হাজার বিক্ষোভকারী ট্রাম্প ইন্টারন্যাশনাল হোটেল অ্যান্ড টাওয়ারের বাইরে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ দেখান। তারা ‘নো ট্রাম্প’, ‘নো কেকেকে’ এবং ‘নো রেসিস্ট ইউএসএ’ স্লোগান দেন। ওই এলাকার রাস্তা আটকে বিক্ষোভকারীদের বাধা দেয় শিকাগো পুলিশ। সেখানে কোনো ধরনের সহিংসতা বা আটকের খবর পাওয়া যায়নি। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া আদ্রিয়ানো রিজ্জো বলেন, ‘এ দেশের কী হতে যাচ্ছে তা ভেবে আমি সত্যি আতঙ্কিত।’ ২২ বছর বয়সী তরুণ যে টি-শার্ট পরেছিলেন, তাতে লেখা—‘যতখানি পার অধিকার উপভোগ করো’।

বিক্ষোভকারীরা মেক্সিকো সীমান্তে ট্রাম্পের দেয়াল তোলার পরিকল্পনা এবং তার অভিবাসন নীতির সমালোচনা করে। বুধবার সন্ধ্যায় শত শত বিক্ষোভকারী ফিলাডেলফিয়া, বোস্টন, পোর্টল্যান্ড, ওরেগনে বিক্ষোভ করে। রিপাবলিকানদের ঘাঁটি বলে পরিচিত টেক্সাসের অস্টিনেও বিক্ষোভ হয় ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। সেখানে প্রায় চারশ বিক্ষোভকারী জড়ো হয়ে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয় বলে স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে। সিয়াটলে শ’খানেক বিক্ষোভকারী ক্যাপিটল হিলের কাছে জড়ো হয়ে সড়ক অবরোধ করে। স্কুল-কলেজের শতাধিক শিক্ষার্থী সিয়াটল, ফিনিক্স, লস অ্যাঞ্জেলেস, ওকল্যান্ড, রিচমন্ড এবং এল ক্যারিতোতে বিক্ষোভ দেখায়। পেনসিলভানিয়ায় ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গের কয়েকশ’ শিক্ষার্থীও রাস্তায় নামে ট্রাম্পের বিরোধিতায়। বুধবার দিনের শুরুর দিকে ১৫০০ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সান ফ্রান্সিসকোর বার্কলে হাইস্কুলের সামনে বিক্ষোভ করে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র অ্যাডাম ব্রেভার বলেন, ‘আমরা বসে থাকতে পারি না। একজন বর্ণবাদী ও নারীবিদ্বেষীকে প্রেসিডেন্ট হতে দিতে পারি না।’ ট্রাম্পের বিজয়কে ‘খুব দুঃখজনক’ হিসেবে বর্ণনা করেন ড্যানিয়েল কলিন নামের আরেক শিক্ষার্থী, যিনি গুয়াতেমালা থেকে আমেরিকার নাগরিকত্ব পেয়েছেন। আরও কয়েকজন লাতিন শিক্ষার্থীর সঙ্গে বিক্ষোভে যোগ দেওয়া কলিন বলেন, লাতিন আমেরিকা থেকে আসা অভিবাসীদের নিয়ে ট্রাম্পের অবস্থানের কারণে তার আমলে তাদের বন্ধু ও স্বজনদের কী হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তারা। লস অ্যাঞ্জেলেসে বুধবার ভোরে লাতিন আমেরিকার শিক্ষার্থী অধ্যুষিত তিন শতাধিক স্কুলের শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে সিটি হলের সামনে বিক্ষোভ করে। স্প্যানিশ ভাষায় তারা স্লোগান দেন, ‘জনগণের ঐক্য পরাজিত হবে না’, ‘অভিবাসীরাই আমেরিকাকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছে’। এই শিক্ষার্থীদের ‘ড্রিমারস’ প্রজন্মের প্রতিনিধি বলা হয়েছে রয়টার্সের প্রতিবেদনে। এদের বাবা-মা অবৈধ উপায়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ায় এখন তাদের দেশ ছাড়তে হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে তারা।

ট্রাম্প আমাদের প্রেসিডেন্ট নন : যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীদের একটি অংশ হতাশ, আতঙ্কিত, বিক্ষুব্ধ। তাদের মুহুর্মুহু স্লোগানে প্রকম্পিত বিভিন্ন শহর। তাদের বিক্ষোভ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। বিক্ষোভকারীদের কণ্ঠে স্লোগান—‘ট্রাম্প আমাদের প্রেসিডেন্ট নন’। রিপাবলিকান পার্টির ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে বুধবার বিক্ষোভ-সমাবেশ হয়েছে। প্রতিবাদী এসব বিক্ষোভ-সমাবেশ থেকে ট্রাম্পবিরোধী আওয়াজ ওঠে। সিএনএন অনলাইন প্রতিবেদনে জানানো হয় এ তথ্য। হোয়াইট হাউসের কাছেও বিক্ষোভকারীদের জড়ো হতে দেখা গেছে। বিক্ষোভকারীরা ট্রাম্পবিরোধী নানা স্লোগান লেখা প্লাকার্ড বহন করেন। তারা চিৎকার করে স্লোগান দেয়। বলে, ‘ট্রাম্প আমাদের প্রেসিডেন্ট নন’, ‘ট্রাম্পকে চাই না’।

ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভে গুলি : ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ চলাকালে ওয়াশিংটনের সিয়াটলে বন্দুকধারীর গুলিতে এক নারীসহ পাঁচজন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছে পুলিশ। গতকাল বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, বুধবার রাতে সিয়াটলের প্রাণকেন্দ্রে ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভস্থলের কাছে এ ঘটনা ঘটে। ট্রাম্পবিরোধী বিক্ষোভ চলাকালে ওয়াশিংটনের সিয়াটলে গুলির ঘটনার পর থার্ড এভিনিউ ও পাইন স্ট্রিট বন্ধ করে দেয় পুলিশ।

বিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবি ক্যালিফোর্নিয়ায় : যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান অঙ্গরাজ্য ক্যালিফোর্নিয়ার জনগণ সত্যি সত্যি দেশটি থেকে বের হয়ে যাওয়ার কথা বিবেচনা করছে। এর কারণ দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়। ‘ইয়েস ক্যালিফোর্নিয়া ইনডিপেনডেন্স ক্যাম্পেইন’ নামে একটি গোষ্ঠী বুধবার থেকে জোরেশোরে এ প্রচার শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের হয়ে যাওয়ার এ প্রক্রিয়া পরিচিতি পেয়েছে ‘ক্যালেক্সিট’ নামে। সন্দেহ নেই, এ বছরের জুলাইয়ে যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ছেড়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া ‘ব্রেক্সিট’-এর নাম অনুসরণ করেই এই নামকরণ। এই গোষ্ঠী ২০২০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য বেশ আগে থেকেই প্রচারণা চালিয়ে আসছে। ইয়েস ক্যালিফোর্নিয়া গোষ্ঠীর ওয়েবসাইটে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহৎ অর্থনীতির অঞ্চল ক্যালিফোর্নিয়া অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে ফ্রান্সের চেয়ে শক্তিশালী। এর জনসংখ্যা পোল্যান্ডের চেয়ে বেশি। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অন্য ৪৯টি অঙ্গরাজ্যের সঙ্গেই নয়, বিভিন্ন বিবেচনায় যে কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে ক্যালিফোর্নিয়া।’

বেশি ভোট পেয়েও পরাজিত হিলারি : ভোটারদের দেওয়া মোট ভোটে এগিয়ে থেকেও ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে হেরে গেলেন হিলারি ক্লিনটন। জিতে গেলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ভোট শেষে এখন পর্যন্ত পাওয়া ৫২২টি ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে ট্রাম্প পেয়েছেন ২৯০ ও হিলারি ২৩২টি। তবে মোট ভোটের মধ্যে হিলারি ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। আর ট্রাম্প পেয়েছেন ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট। সিএনএনের হিসাবে, এখন পর্যন্ত ৯২ শতাংশ ভোট গণনা হয়েছে। এর মধ্যে হিলারি পেয়েছেন ৫ কোটি ৯৭ লাখ ৫৫ হাজার ২৮৪ ভোট। আর ট্রাম্প পেয়েছেন ৫ কোটি ৯৫ লাখ ৩৫ হাজার ৫২২ ভোট। পার্থক্য মাত্র ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৬২ ভোটের।

ট্রাম্পের মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য উধাও : যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হবে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের এমন বক্তব্য তার ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখন ওই পাতায় ক্লিক করলে দেখা যায় সেখানে ভোটারদের তার নির্বাচনী প্রচারে তহবিল দানের জন্য উৎসাহিত করার কথা। ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান বার্নার্দিনোতে মুসলিম দম্পতির রক্তক্ষয়ী বন্দুক হামলার পর ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার পক্ষে মত দেন।

ট্রাম্প ও তার সমর্থকরা বারবারই এ নিষেধাজ্ঞার পক্ষে আত্মপক্ষ সমর্থন করে গেছেন। বলেছেন, ‘ধর্মীয় কোনো বিভেদ নয়, বরং আমেরিকানদের ‘‘নিরাপত্তার’’ স্বার্থে এমনটা করতে হবে।’ নির্বাচনের দিন ৮ নভেম্বর মঙ্গলবার সকালেও ওয়েব পেজে তার ওই ভাষণের ভিডিও ছিল। কিন্তু রাতে নির্বাচনে জয়ের আভাস পাওয়ার পরপরই তা আর পাওয়া যায়নি।

সর্বশেষ খবর