শুক্রবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

হঠাৎ রুপির অভাবে অচল ভারত

কলকাতা ও বেনাপোল প্রতিনিধি

হঠাৎ রুপির অভাবে অচল ভারত

পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ভারত সরকার ৫০০ ও ১ হাজার রুপির নোট বাতিল করায় গোটা ভারতসহ ভারতে যাতায়াতকারী বিদেশিদের মহা ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। সরকারি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ভারতে হঠাৎই রুপির অভাব দেখা দিয়েছে। ডলারের বিপরীতে রুপি না পেয়ে বিদেশিরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। এ নিয়ে ভারতে এক ধরনের অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।

প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৩ লাখের মতো মানুষ ব্যবসা, চিকিৎসা এবং পর্যটনের জন্য ভারতে যান। তাদের অনেকের কাছেই নগদ ভারতীয় রুপি জমা থাকে। নোট বাতিলের কারণে শুধু বাংলাদেশিরাই নয়, বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় নাগরিকরাও ঝামেলায় পড়েছেন। জানা গেছে, গত মঙ্গলবার ভারতে ৫০০ এবং ১০০০ রুপির নোট নিষিদ্ধ করার পর বহু মানুষ ভিড় জমিয়েছেন মানি এক্সচেঞ্জগুলোতে। কিন্তু নিজেদের কাছে থাকা সে রুপি তারা বিনিময় করতে        পারেননি। মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো ৫০০ এবং ১০০০ রুপির ভারতীর নোট গ্রহণ করছে না। ঢাকার একটি মানি এক্সচেঞ্জের কর্মী ফারুক হোসেন জানান, তাদের কাছে প্রায় ৬৫ হাজার ভারতীয় রুপি আছে, যার সবগুলোই ৫০০ এবং ১০০০ রুপির নোট। এ নোট নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তে তিনি বিপাকে পড়েছেন। এদিকে ভারতে যারা ডলার ভাঙিয়ে ৫০০ কিংবা ১০০০ রুপির নোট রেখেছেন তারা এখন কোথাও থেকে এই নোট ভাঙাতে পারছেন না। এমনকি হোটেলে গিয়েও এ রুপি দিয়ে খেতে পারছেন না। যানবাহন, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে কোথাও এ নোট কেউ নিচ্ছে না। ফলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন পর্যটকরা। বেশিরভাগ পর্যটকই এখন নিজেদের ভিখারি মনে করছেন। মোটা অঙ্কের রুপি থাকলেও এখন তারা অসহায়। তাদের অনেকেই তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফের দেশে ফিরে যেতে চাইছেন। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, চিকিৎসা ও বিয়ের কেনাকাটা করতে পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন বহু বাংলাদেশি পর্যটক। ঢাকা থেকে কলকাতা-নিউটাউনে অবস্থিত টাটা ক্যান্সার হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে আসা হাসিনা আখতার বলেন, ‘আমি ক্যান্সারে আক্রান্ত। বাংলাদেশে ভালো চিকিৎসা না পাওয়ায় কলকাতা এসেছি। আমার খুব শিগগির কেমো থেরাপি করা প্রয়োজন। কারণ এর ওপরেই আমার বেঁচে থাকা নির্ভর করছে। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে থাকা ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট নিচ্ছে না। এ অবস্থায় আমাকে চিকিৎসা না করিয়েই দেশে ফিরে যেতে হবে।’ কলকাতায় চিকিৎসা করাতে আসা কুমিল্লার শেখ জামালউদ্দিন বলেন, ‘এখানে ডাক্তার দেখাতে এসেছি। কিন্তু হঠাৎ ৫০০ ও ১ হাজার রুপি নিয়ে সরকারের এই সিদ্ধান্তের জন্য আমরা আজ ডাক্তার দেখাতে পারিনি, খাবার খেতেও সমস্যায় পড়তে হয়েছে। ৫০০ ও ১ হাজারের নোট ছাড়া আমাদের কাছে অন্য রুপি নেই। এখন কী করব বুঝতে পারছি না।’ কলকাতার এক নামি চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত বেশিরভাগ বড় বেসরকারি হাসপাতালগুলোই চিকিৎসা পর্যটন থেকে ৫ থেকে ১০ শতাংশ রাজস্ব আদায় করে থাকে। কিন্তু নোট সমস্যায় রোগীদের ভোগান্তির পাশাপাশি চিকিৎসা পরিষেবাও আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে।’ জানা গেছে, কলকাতায় চিকিৎসা করতে আসা অগণিত বাংলাদেশি নাগরিকেরই অবস্থা করুণ। কলকাতায় এসে সদর স্ট্রিটের একটি হোটেলে ওঠা বাংলাদেশি পর্যটক আমির হোসেন মণ্ডল জানান, ‘গত পরশু রাত থেকেই রুপি নিয়ে প্রচণ্ড সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। অমরা সবাই অনেক রুপি নিয়ে এসেছি। কিন্তু যখন খাবার কিংবা অন্য জিনিস কিনতে যাচ্ছি তখন দোকানদার ৫০০ রুপি ও ১ হাজার রুপির নোট নিচ্ছে না। সবার কাছ থেকে ভাঙতি নিয়ে আজকের দুপুরের খাবার খেয়েছি। কিন্তু পরে খাবারের রুপি নেই।’

এদিকে বিদেশি পর্যটকদের পাশাপাশি ভারতীয় নাগরিকদেরও চূড়ান্ত হয়রানি ও আতঙ্কের মধ্যে পড়তে হয়েছে। গত বুধবার ভারতে ব্যাংক পরিসেবা বন্ধ থাকার পর গতকাল ব্যাংক খোলার পর প্রতিটি ব্যাংকের সামনেই গ্রাহকদের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। ব্যাংক খুলতেই পুরনো রুপি জমা দেওয়া ও নতুন রুপি তোলার হিড়িক পড়ে। ভিড়ের চাপে একাধিক ব্যাংকে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে ব্যাংকগুলোতে নিরাপত্তাবাহিনী মোতায়েন করতে হয়। এইসঙ্গে সব এটিএম কাউন্টার বন্ধ রাখায় চূড়ান্ত হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে গ্রাহকদের। এমনকি শহর ও শহরতলির বাজারে যারা ঢুকেছিলেন তাদেরও নাজেহাল হতে হয়। ১০০ রুপির নোট নিয়ে যারা বাজারে এসেছিলেন তাদের সামান্য শাকসবজি মাছ কিনেই বাড়িতে ফিরতে হয়, মুদি দোকানে আর তাদের যাওয়া হয়নি। কারণ ছোট নোট নেই।

৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট বাতিল হওয়ায় প্রভাব পড়েছে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের উপরেও। দুই দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর পেট্রাপোল-বেনাপোল দিয়ে প্রতিদিন কয়েকশ মানুষ যাতায়াত করেন। আমদানি-রপ্তানির জন্য অসংখ্য ট্রাকও যাতায়াত করে। কিন্তু রুপি বদল করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন যাত্রীরা। সীমান্তে আমদানি-রপ্তানি করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছেন ব্যবসায়ীরাও। ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট গ্রহণ করা হবে না—বলে কেন্দ্রীয় সরকারের সেন্টার ওয়ার হাউসিং করপোরেশন (সিডব্লিউসি)-এর তরফ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর এই সুযোগে সীমান্তে কালোবাজারি শুরু হয়েছে। গতকাল ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা পাসপোর্টযাত্রী মৃণাল কান্তি বিশ্বাস (পাসপোর্ট নং- বিএল- ০৩১২১২২৪) জানান, ভারতের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, রেল অফিস, পরিবহন কাউন্টার—এমন কি খাদ্যদ্রব্য বিক্রির দোকান এবং হোটেলেও এ রুপি নিচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশি পাসপোর্টযাত্রীরা তাদের কাছে থাকা রুপি কম মূল্যে বিক্রি করছেন।

বাংলাদেশি অনেক পাসপোর্টযাত্রী অভিযোগ করে জানিয়েছেন, ভারতীয় রুপি বাজেয়াপ্ত ঘোষণার  আগে ভারতে অবস্থানকারী যাত্রীদের নিকট থাকা ৫০০ ও ১০০০ নোটের রুপি থাকলেও তা তারা স্থানীয় ব্যাংক কিংবা মানি এক্সচেঞ্জারগুলোতে ভাঙাতে না পারায় নিঃস্ব হাতে দেশে ফিরেছেন। তারা আরও জানান, স্থানীয় দালালরা এখন অর্ধেক মূল্যেও রুপি কিনছে না।

সর্বশেষ খবর