শনিবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

পুলিশকে কমিশনারের ওয়ার্নিং

সাখাওয়াত কাওসার ও আলী আজম

পুলিশকে কমিশনারের ওয়ার্নিং

অন্তহীন অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে। অভিযোগের পর তদন্ত কমিটি হয়, তদন্ত হয়। কিন্তু অধিকাংশ তদন্ত প্রতিবেদনই থেকে যায় আড়ালে। অপরাধ প্রমাণের পরও প্রত্যাহার, সাময়িক বরখাস্ত, বদলির মধ্যেই আটকে থাকে শাস্তি। একশ্রেণির অসাধু পুলিশ সদস্যের নানা অপকর্ম, অনিয়ম ও অপরাধের কারণে ঐতিহ্যবাহী এই বাহিনী নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। বিভিন্ন সময় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসব বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করলেও অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। সর্বশেষ গত ১৭ অক্টোবর ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে ডিএমপি সদস্যদের ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছে। থানা পর্যায়ে সেবার মান বাড়াতে ডিএমপি কমিশনারের ২২টি বিশেষ নির্দেশনাতেও ‘থোড়াই কেয়ার’ দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ সদস্যরা। জানা গেছে, রাজধানীতে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা, অপহরণ, খুন, ছিনতাই, মানবাধিকার লঙ্ঘন বা নির্যাতন, আটক করে ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ঘটনা। গত আগস্টে পাওনা টাকা এবং জমি দখল-উচ্ছেদের বিষয়ে পুলিশ সদস্যদের বিরত থাকতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন ডিএমপি কমিশনার। তবুও ক্ষমতার অপব্যবহার করে পুলিশের দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যরা বিভিন্ন শক্তিমান ব্যক্তির ঢাল হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছেন। সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুর বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন আল্লাহ করিম মসজিদ মার্কেটের কমিটি-সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও এক পক্ষকে ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জামাল উদ্দীন মীরের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি ওসি ওই মার্কেটের পাঁচটি দোকানের ভাড়াটিয়াদের  ভাড়া না দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। ওই মার্কেটের এক দোকান মালিক আবদুল কাদের বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় এক কাউন্সিলরের লোকজন মসজিদ মার্কেটের দোকান দখলের চেষ্টা করছেন। কমিটি-পাল্টা কমিটি নিয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকার পরও ওসি সাহেব আমাকে থানায় ডেকেছিলেন। সেখানে তিনি আমাকে দোকানদারদের কাছ থেকে ভাড়া না নিতে নির্দেশ দিয়েছেন।’

তবে প্রতিবেদকের কাছে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ওসি জামাল উদ্দীন মীর। এ বিষয়টি নিয়ে এক ভাড়াটিয়া শাহীনের সঙ্গে কথা বললে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘রাজীব কমিশনার আমাদের তার অফিসে ডেকে নিয়ে শাসিয়েছেন। তাদের ভাড়া দেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। আজ পর্যন্ত আমিসহ আরও চারজন ভাড়া দিইনি।’

সম্প্রতি খিলক্ষেত এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের এক নেতার বিরুদ্ধে দুই তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। ধর্ষিতা দুই তরুণীর মায়েরা থানায় গিয়েছিলেন অভিযোগ দিতে। কিন্তু বেঁকে বসেন খিলক্ষেত থানার ওসি শহিদুল হক। মামলা না নিয়ে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে ধর্ষকের একটি আপস করিয়ে ২ নভেম্বর একটি আপসনামা আদায় করেন তিনি। এ ব্যাপারে গত রাতে ওসি শহিদুল হক বলেন, অভিযোগ এসেছিল। তবে সত্যতা না পাওয়ায় মামলা রেকর্ড করা হয়নি। এদিকে সর্বশেষ পুলিশকে জনবান্ধব করতে ১৭ অক্টোবর ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে অতিরিক্ত কমিশনার ও যুগ্ম-কমিশনার পদমর্যাদার আট পদস্থ কর্মকর্তার মধ্যে ডিএমপির ৪৯ থানা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। তাদের দায়িত্ব থানার সার্বিক কর্মকাণ্ড ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তত্ত্বাবধান করা। সংশ্লিষ্ট থানা এলাকার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য ডিসি, এডিসি, এসি এবং ওসিদের পাশাপাশি এই আট কর্মকর্তাকে ডিএমপি কমিশনারের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদসহ সব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তারা ডিএমপি কমিশনারের কাছে বার্তা পৌঁছে দেবেন। ইতিমধ্যে তারা সংশ্লিষ্ট থানা ভিজিট করে দিকনির্দেশনামূলক বিভিন্ন উপদেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট ক্রাইম বিভাগের ডিসি, এডিসি, এসি ও ওসিদের নিয়ে নিয়মিত বৈঠক করে দিকনির্দেশনাও দিচ্ছেন এই পদস্থ কর্মকর্তারা।

যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে : রমনা বিভাগের সব থানার দায়িত্বে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (প্রশাসন) মো. শাহাব উদ্দীন কোরেশী; মতিঝিল বিভাগে সব থানার দায়িত্বে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (লজিস্টিকস, ফিন্যান্স অ্যান্ড প্রকিউরমেন্ট) জামিল আহমদ; ওয়ারী বিভাগের সব থানার দায়িত্বে যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (লজিস্টিকস) ওয়াই এম বেলালুর রহমান; উত্তরা বিভাগের সব থানার দায়িত্বে যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার (অপারেশনস) মীর রেজাউল আলম; লালবাগ বিভাগের সব থানার দায়িত্বে যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায়; তেজগাঁও বিভাগের সব থানার দায়িত্বে যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার (সদর দফতর) মো. আনোয়ার হোসেন; মিরপুর বিভাগের সব থানার দায়িত্বে যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার (পিওএম) ইমতিয়াজ আহমেদ এবং গুলশান বিভাগের সব থানার দায়িত্বে যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার (প্রটেকশন অ্যান্ড ডিপ্লোম্যাটিক সিকিউরিটি) মো. আতাউল কিবরিয়া।

এ ব্যাপরে ডিএমপির যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘থানাকে জনবান্ধব করার জন্য কমিশনার স্যারের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা দায়িত্ব পালন করছি। ইতিমধ্যে আমি আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত এরিয়ার থানাগুলো পরিদর্শন করেছি। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।’

যেসব নির্দেশনা : কঠোর হুঁশিয়ারির মধ্যে রয়েছে— বিভাগীয় অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ছাড়া থানা থেকে সিভিল টিম বের করা যাবে না। পুলিশের কিছু সদস্যের জনগণের সঙ্গে হয়রানিমূলক আচরণের অভিযোগ রয়েছে; সকল প্রকার হয়রানি ও জুলুম বন্ধ করতে হবে। পেন্ডিং মামলায় কাউকে শ্যোন অ্যারেস্ট করতে হলে সংশ্লিষ্ট জোনের এসির অনুমতি লাগবে। মাদক বা অস্ত্র দিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিরপরাধ লোকের বিরুদ্ধে মামলা না দেওয়া। মোবাইল পার্টির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কোনো আসামি আটকের পর গাড়িতে রেখে তদবির কিংবা টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়ার দেনদরবার করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই কর্মকর্তা প্রতিদিন একই ধরনের ডিউটি করতে পারবেন না এবং মামলার তদন্ত শেষে দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে।

জনবান্ধব পুলিশিং বাস্তবায়নে নিয়মিত ও কার্যকর উঠান বৈঠক আয়োজন করা, জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে পুলিশভীতি এবং অপরাধের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে অপরাধভীতি দূর করতে হবে। সংগৃহীত ভাড়াটিয়া তথ্য দ্রুত তদারকি ও যাচাই-বাছাই করতে হবে। সিআইএমএস সফটওয়্যারে নির্ভুল তথ্য ও সম্পূর্ণ তথ্য নিশ্চিত করতে হবে।

জঙ্গি দমনে গৃহীত কার্যক্রম বাস্তবায়নে কোনোরূপ শৈথিল্য প্রদর্শন করা যাবে না। নিয়মিত ব্লক রেইড, তল্লাশি ও চেকপোস্টের কাজ অব্যাহত রাখতে হবে। উঠান বৈঠক ও জনসংযোগের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করতে হবে। নিখোঁজ যুবকদের তালিকা করে অনুসন্ধান ও তদারকি, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, ব্যক্তি এবং বিদেশিদের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। থানার হেফাজতে ব্যবহূত মালামাল ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহার হচ্ছে কিনা তা তদারকি করতে বলা হয়েছে। প্রশিক্ষিত বা দায়িত্বপ্রাপ্ত না হলে এসব সরঞ্জাম ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। আলামত সংরক্ষণে থানার পরিবেশ নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা। অনিষ্পন্ন আলামত আদালতের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিষ্পন্ন করা। থানার আঙিনা পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

সর্বশেষ খবর