রবিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ফুটপাথে চাঁদাবাজির উৎসব

তোলা পুলিশ রাজনীতিক মহল সবার নামেই । হকার উচ্ছেদ ও পুনর্বাসনে বাধার শেষ নেই

সাঈদুর রহমান রিমন

ফুটপাথে চাঁদাবাজির উৎসব

ফুটপাথ নাকি মার্কেট! রাজধানীজুড়েই এখন এ চিত্র । কোথাও কোথাও দোকান বসানো হয়েছে রাস্তায়। গুলিস্তান আন্ডারপাসের পাশ থেকে গতকাল তোলা ছবি —জয়ীতা রায়

হকার উচ্ছেদে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে চাঁদাবাজ চক্র। দুই মেয়রের ‘ফুটপাথ-রাস্তা দখল মুক্ত’ করার সব অভিযান বারবার ব্যর্থ করে দিচ্ছে তারা। ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী, সিটি করপোরেশনের দুর্নীতিবাজ কর্মচারী ও পুলিশের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এ সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজ চক্র। শুধু গুলিস্তান এলাকার ফুটপাথ-রাস্তা থেকেই এ চক্র প্রতিদিন হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। রাজধানীর অন্যান্য এলাকার ফুটপাথ-হকার মিলিয়ে মাসে অন্তত কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়ে থাকে। মোটা অঙ্কের এই চাঁদাবাজি বহাল রাখতে প্রভাবশালী চক্রটি উচ্ছেদকারীদের ওপর হামলা-মামলা ও আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়ে থাকে। তাদের অপতত্পরতার কারণে হকার উচ্ছেদ দুই মেয়রের জন্য এখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হকার উচ্ছেদে সিটি করপোরেশন সোচ্চার হলেও পুলিশ ও রাজনৈতিক বলয়ের চাপে তা সম্ভব হয় না। সিটি করপোরেশন এখন গুলিস্তান উচ্ছেদ নিয়ে বিপাকে। একজন হকারের মামলাকে ঘিরে পুলিশ চাপে রেখেছে সিটি করপোরেশনকে। সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে করা গণমামলা ঘিরে আতঙ্ক চলছে নগর ভবনে। অন্যদিকে হকাররা বলছেন, পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ কোনোভাবেই কাম্য নয়। আর নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে হকারদের বসানো যায়। কিন্তু নাগরিকদের চলাচলের জন্য ফুটপাথ খোলা রাখার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, অভিযানের কিছুক্ষণ পরই ফুটপাথে হকারদের বসিয়ে দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতারা। এর বিনিময়ে প্রতিদিন হকারদের কাছ থেকে তারা তুলে নিচ্ছেন চাঁদা। সেই চাঁদার ভাগ যাচ্ছে পুলিশের পকেটেও। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর ফুটপাথগুলোর দখল এখন নির্বাচিত ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের হাতে। ঢাকার অন্তত ২২ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।

গুলিস্তানের ফুটপাথের ৩০টি ফুটপাথে দোকান রয়েছে সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজারের কাছাকাছি। দোকান ও পজিশন-হারে প্রতি দোকান থেকে দৈনিক চাঁদা আদায় হচ্ছে ১৫০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত। আর এ টাকা লাইনম্যানদের হাত হয়ে চলে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজনৈতিক নেতা ও মাস্তানদের পকেটে। ফলে এখানকার লাইনম্যান নামধারী চাঁদাবাজরা ক্ষমতার দাপটে চরম বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এরা চাঁদা আদায়ে এতই বেপরোয়া যে নির্ধারিত চাঁদা দিতে দেরি হলে হকারদের মালামাল তছনছ করে রাস্তায় ফেলে দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হকারদের মারধরও করে। লাইনম্যান চাঁদাবাজদের সর্দার হিসেবে রয়েছে দুজন। প্রথমজন বাবুল সর্দার— তিনি রাজনৈতিক নেতা ও পেশাদার মাস্তানদের কাছে চাঁদার অংশ পৌঁছে দেন। দ্বিতীয়জন সর্দার আমিন— তিনি চাঁদাবাজির প্রাপ্য অংশের টাকা পৌঁছে দেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। এ দুই চাঁদাবাজ-সর্দারই রাজধানীতে বাড়ি-গাড়ির মালিক বনেছেন। প্লট-ফ্ল্যাট, ব্যাংক ব্যালেন্সেরও কমতি নেই তাদের। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা খালিদ আহমেদ বলেন, ‘আমরা নিয়মিতই ফুটপাথ উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করে থাকি। কিন্তু জনবল সংকটের কারণে আমাদের সার্বক্ষণিক নজরদারির অভাবে আবারও ফুটপাথ দখল হয়ে যায়। অভিযানের পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি আইন প্রয়োগ করত, তাহলে এ অবস্থা হতো না।’

লাইনম্যান চাঁদাবাজ যারা : বায়তুল মোকাররম ১ নম্বর গেটে চটপটি কাদির, ভোলা ও কানা সিরাজ; ভাসানী স্টেডিয়াম আলী মিয়া, লম্বা হারুন ও দেলোয়ার; নাট্যমঞ্চ খোরশেদ ও কবির হোসেন; ট্রেড সেন্টারের আশপাশ নাছির, রাহাত ও লুত্ফর; সিটি সেন্টার  স্বপন; বঙ্গবন্ধু স্কয়ার চিংড়ি বাবুল, লিপু ও হিন্দু বাবুল; বঙ্গবন্ধু স্কয়ার হাঁপানি রব, রুহুল মিয়া ও সুলতান; আওয়ামী লীগ অফিস গলি আখতার, মোচ জাহাঙ্গীর ও সর্দার সালাম; জিপিওর আশপাশ কোটন ও ঘাউরা বাবুল। এ ছাড়া সিটি করপোরেশন মার্কেট সিটি সেন্টার পুরোটাই দখল করে রেখেছেন ৩২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মনু মিয়া। তার প্রভাবে ভবনটির নির্মাণকাজ পর্যন্ত সিটি করপোরেশন সম্পন্ন করতে পারছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। দখল-উচ্ছেদ-পুনর্দখল : হকার সমিতিগুলোর হিসাবে, ঢাকায় প্রায় দুই লাখ ৬০ হাজার হকার আছেন। এর মধ্যে দেড় লাখ হকার ফুটপাথে বসে। ২৫ হাজার রাস্তায় দোকানদারি করে। আর ২৫ হাজার মৌসুমি হকার। এরা রোজার ঈদ ও কোরবানির ঈদের সময় ঢাকায় আসেন। বাকি হকাররা গণপরিবহন, বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় নানা পণ্য বিক্রি করে থাকেন। এসব হকারের কাছ থেকে প্রতিদিন স্থানভেদে ৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়। ঈদ কিংবা উৎসবে এ চাঁদার হার আরও বেড়ে যায়। বছরে এর পরিমাণ ৯০০ কোটি টাকার বেশি। রমরমা এ চাঁদাবাজির কারণেই সকালে হকার উচ্ছেদ করলে বিকালে পুনরায় বসে যায়। ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ সর্বশেষ ২৭ অক্টোবর হকার ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে গেলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর হামলা চালায় হকার নামধারী এসব চাঁদাবাজরা। এরপরও উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত রাখে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এক দিন পরই চাঁদাবাজদের নেতৃত্বে আবারও ফুটপাথ দখল হয়ে যায়।

ঘোষিত ২০ মার্কেট : হকারদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে এবং তাদের জীবিকানির্বাহের স্বার্থে ২০০৭ সালের ২১ নভেম্বর সরকারি সিদ্ধান্ত হয়। সে মোতাবেক রাজধানীর নির্ধারিত ২০টি স্থানে অস্থায়ীভাবে ফুটপাথে দোকান বসানোর ও মালামাল বিক্রির অনুমতি দিয়ে সচিবের স্বাক্ষর-সংবলিত গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তৎকালীন অবিভক্ত সিটি করপোরেশন। বিষয়টি গণমাধ্যমেও ফলাও করে প্রচার হয় তখন। কিন্তু গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেই দায়িত্ব শেষ করে তৎকালীন সিটি করপোরেশন। এসব সাপ্তাহিক মার্কেটের ব্যাপারে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন থেকে এখন আর স্পষ্ট কিছু বলা হচ্ছে না।

সর্বশেষ খবর