সোমবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ভবন ভাঙতে চায় না বিজিএমইএ

রুহুল আমিন রাসেল

ভবন ভাঙতে চায় না বিজিএমইএ

তিন বছর সময় চেয়ে আবেদন করবে ব্যবসায়ী সংগঠনটি, রাষ্ট্রপতির অনুকম্পা চাইতে পারেন পোশাক মালিকরা, রাষ্ট্রপতির অনুকম্পার ক্ষমতা নেই : ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ

হাতিরঝিলের ক্যান্সার হিসেবে চিহ্নিত পোশাকশিল্প মালিকদের অবৈধ ১৬ তলা ভবনটি আগামী তিন বছরেও ভাঙতে চায় না বিজিএমইএ। এ জন্য উচ্চ আদালতে রায় পুনর্বিবেচনা ও ভবন ভাঙতে তিন বছর সময় চেয়ে আবেদন করা হবে। সর্বশেষ পোশাকশিল্প মালিকরা ভবন রক্ষায় রাষ্ট্রপতির অনুকম্পাও চাইতে পারেন বলে জানা গেছে। যদিও আদালতের দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপিতে বিজিএমইএকে নিজস্ব খরচে ভবন ভাঙার নির্দেশ দেওয়া আছে। তবে বিজিএমইএ তা না করলে পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে রাজউককে ভবন ভাঙার নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, একমাত্র শাস্তি হিসেবে যদি কাউকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়, তাহলে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারেন। তা নিয়ে রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতা আছে। কিন্তু এভাবে ভবন ভাঙা বা রাস্তা ও নদীর মধ্যে দালান তোলা নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতে যদি রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) খারিজ হয়ে যায়, তাহলে রাষ্ট্রপতির তেমন কোনো ক্ষমতা সংবিধানে নেই। এটা ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, স্থাপনার ক্ষেত্রে নয়। ব্যক্তির ক্ষেত্রে কেউ যদি প্রাণভিক্ষা চায়, তাহলে রাষ্ট্রপতির প্রাণভিক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা আছে। দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্প উদ্যোক্তা-মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিজিএমইএর ভবন ভাঙতে হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশ বহাল রেখে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি ৮ নভেম্বর প্রকাশ হয়। বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দারের লেখা ৩৫ পৃষ্ঠার এই রায় প্রকাশ করে সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইট। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিজিএমইএকে অবিলম্বে নিজস্ব খরচে ১৬ তলা ভবন ভাঙার নির্দেশ দেওয়া হয়। জমির স্বত্ব না থাকা এবং জলাধার আইন লঙ্ঘন করে রাজধানীর হাতিরঝিলের দৃষ্টিনন্দন প্রকল্প এলাকায় নির্মিত বিজিএমইএ ভবনটি ভাঙতে পাঁচ বছর আগে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। ওই রায়ের পর বিজিএমইএ লিভ টু আপিল করে। আপিলের সেই আবেদন খারিজ করে গত ২ জুন রায় দেয় আপিল বিভাগ। পরে ৮ নভেম্বর সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ হয়।

এখন এই রায়ের বিরুদ্ধে বিজিএমইএ রিভিউ আবেদন করতে পারবে। অন্যথায় এই ভবন ভাঙতে আর কোনো আইনি বাধা নেই। এমন আইনি বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতিক সময়ে বিজিএমইএর শীর্ষ নেতারা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বলে জানা গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজিএমইএর একাধিক শীর্ষ নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে নিশ্চিত করেছেন, উচ্চ আদালতে রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ হওয়ায় এখন নির্ধারিত সময়ের শেষ দিকে আপিলের চূড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন্য আবেদন করবে বিজিএমইএ। এক্ষেত্রে আরও নতুন কোনো সুযোগ আছে কিনা, তাও খুঁজছেন পোশাকশিল্প মালিকরা। বিজিএমইএ সূত্র জানায়, বর্তমান ভবন ভেঙে রাজধানীর উত্তরায় নতুন ভবন নির্মাণে ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিজিএমইএ বিনামূল্যে ৯ বিঘা জমি চেয়েছে সরকারের কাছে। তবে সরকার তাতেও আপত্তি তুলেছে। তাই পোশাকশিল্পের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে ভবন ভাঙতে আদালতের কাছে যৌক্তিক সময় চাওয়ার পথেই এগোচ্ছে বিজিএমইএ।  এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই উচ্চ আদালতের দেওয়া চুড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করা হবে। একই সঙ্গে এই আবেদনে আমাদের নতুন ভবন নির্মাণ ও পোশাকশিল্পের বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে আদালতের কাছে আরও দুই থেকে তিন বছর পর বিজিএমইএ ভবন ভাঙার জন্য সময় চাওয়া হবে। প্রায় দুই দশক আগে বেগুনবাড়ী খালের ওপর নির্মাণ করা বিজিএমইএ ১৬ তলাবিশিষ্ট ভবন ভাঙতে হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশ গত ২ জুন বহাল রাখে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল হাইকোর্ট ভবনটি ভাঙার নির্দেশ দেয়। চলতি বছরের ১৯ মার্চ ওই রায়ের পূর্ণ অনুলিপি প্রকাশ হয়। পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, বিজিএমইএ ভবন সৌন্দর্যমণ্ডিত হাতিরঝিল প্রকল্পে একটি ক্যান্সারের মতো। হাতিরঝিল প্রকল্প একটি জনকল্যাণমূলক প্রকল্প। কাজেই সরকার ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের ওপর নির্দেশ হলো, ভবনটি ৯০ দিনের মধ্যে ভেঙে ফেলতে হবে। জানা গেছে, আপিল বিভাগের রায়ের পর হাতিরঝিলের বিজিএমইএ ভবন রক্ষার আশা ছেড়ে দিয়েছেন এই খাতের উদ্যোক্তাদের শীর্ষ নেতারা। তারপরও ভবন রক্ষায় সর্বশেষ আইনি লড়াইয়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে ভবন নির্মাণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে বিজিএমইএ। জমিও দেখা শেষ পর্যায়ে। সব দিক বিবেচনায় উত্তরায় নতুন ভবন তৈরিতেই আগ্রহী পোশাকশিল্প মালিকরা। এর আগে ২০১১ সালে তৎকালীন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ জমির স্বত্ব না থাকা ও জলাধার আইন লঙ্ঘন করে বিধিবহির্ভূতভাবে নির্মাণ করায় বিজিএমইএ ভবন ভাঙার রায় দেয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে বিজিএমইএ আপিল করে। চলতি বছরের ২ জুন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের বেঞ্চ বিজিএমইএর আপিল আবেদন খারিজ করে দেয়।

১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিজিএমইএ ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। তখন এই ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর বিএনপি শাসনামলে নির্মাণ শেষে ২০০৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ভবনটি উদ্বোধন করেন। পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনের দাবি— উন্মুক্ত স্থান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ লঙ্ঘন করে প্রাকৃতিক জলাধারের শ্রেণি বা প্রকৃতি পরিবর্তনের জন্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই বিজিএমইএ ভবন নির্মাণের জন্য হাতিরঝিলের বেগুনবাড়ী খালের একাংশ ভরাট করে ফেলা হয় এবং এতে খালের গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে, এটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।

মামলার পূর্বাপর : রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদন ছাড়া হাতিরঝিলে বিজিএমইএ ভবন নির্মাণ করা হয়েছে বলে ২০১০ সালের ২ অক্টোবর একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ওই প্রতিবেদনটি আদালতের দৃষ্টিতে আনেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ডি এইচ এম মুনিরউদ্দিন। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। রুলে বিজিএমইএ ভবন ভাঙার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। রুলের শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ইকবাল কবির (বর্তমানে হাইকোর্টের বিচারপতি) ও মনজিল মোরসেদের বক্তব্য গ্রহণ করে আদালত। এ রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী (পরে তিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে অবসর নেন) এবং বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বিজিএমইএ ভবন অবৈধ ঘোষণা করে তা ভাঙার নির্দেশ দেয়। বিজিএমইএ ভবনটি ভেঙে ফেলতে হাইকোর্টের দেওয়া ৬৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে আরও বলা হয়, বিজিএমইএ যাদের কাছে ওই ভবনের ফ্ল্যাট বা অংশ বিক্রি করেছে, দাবি পাওয়ার এক বছরের মধ্যে তাদের টাকা ফেরত দিতে হবে। হাইকোর্ট বলেছে, ক্রেতাদের সঙ্গে ওই চুক্তি ছিল বেআইনি। কারণ, ওই জায়গায় ভবন নির্মাণ বা কোনো অংশ কারও কাছে বিক্রির কোনো অধিকার বিজিএমইএর ছিল না। তবে ক্রেতারা যেহেতু নিজেরাও জানত বা তাদের জানা উচিত ছিল যে, এই জমির ওপর বিজিএমইএর কোনো মালিকানা নেই এবং ভবনটি বেআইনিভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। সুতরাং তারা কোনো ইন্টারেস্ট পাওয়ার দাবিদার নয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর