সোমবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

তৃণমূলে কোন্দল, উদ্বেগ হাইকমান্ডে

আওয়ামী লীগের রাজনীতি

রফিকুল ইসলাম রনি

তৃণমূলে কোন্দল, উদ্বেগ হাইকমান্ডে

আওয়ামী লীগের তৃণমূলে নিভছে না ঘরের আগুন। জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে উঠে আসা নতুন নেতৃত্ব যখন জেলা সফরের মাধ্যমে সংগঠনকে আরও গতিশীল করতে উদ্যোগী, তখন হঠাৎ মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের দ্বন্দ্ব ও বিরোধে উদ্বিগ্ন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। অভ্যন্তরীণ কোন্দল, আধিপত্য বিস্তার, সুযোগসন্ধানীদের তত্পরতাসহ নানামুখী সমস্যায় জড়িয়ে পড়ছে তৃণমূল আওয়ামী লীগ। বিষয়টি আমলে নিয়ে যে কোনো মূল্যে এ দ্বন্দ্ব দূর করতে চায় ক্ষমতাসীন দলটি। দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা বারবার মন্ত্রী-এমপিদের তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে বিরোধ ও দূরত্ব কমিয়ে আনার তাগিদ দিচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘একটি বড় রাজনৈতিক দল বড় পরিবার। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যেমন টুকটাক সমস্যা হতে পারে, তেমনি দলেও হতে পারে। এসব সমস্যা সামাধান করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তবে কেউ অপরাধ করে ছাড় পাবে না। দলীয় সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদক এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে। যেখানেই দলীয় কোন্দল বা দলের নাম ভাঙিয়ে অপরাধ করা হবে, সেখানেই তদন্ত সাপেক্ষে চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

দলের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম এনামুল হক শামীম বলেন, আওয়ামী লীগ একটা আদর্শিক দল। এ দলের মধ্যে কোন্দল বা বিরোধ আছে বলা যাবে না। তবে এত বড় দলে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা রয়েছে। যদি ভুল-বোঝাবুঝি হয়েও থাকে তা নিরসন করা হবে। তবে কেউ অন্যায়ভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দলীয় সূত্রমতে, সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা এবং গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ওপর হামলার ঘটনায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে দলীয় নেতা-কর্মীদের নাম আসায় এবং দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে দলের পক্ষ থেকে পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একইভাবে সিরাজগঞ্জের তাড়াশে এমপির লোকজনের হাতে হামলার শিকার উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সভাপতি আহত হওয়ার ঘটনায় দুই সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতাদের নিজেদের মধ্যে বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে বারবার নির্দেশ দিয়েছেন। কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে তিনি বলেছেন—দ্বন্দ্ব নিরসন না করলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এমপি-মন্ত্রীদের পাশে এখন ত্যাগী নেতা-কর্মীরা ভিড়তে পারেন না। ভুঁইফোড়রাই নেতৃত্বের অগ্রভাগে। রাজপথে থাকা ত্যাগী, সংগ্রামী ও কর্মিবান্ধব নেতারা এখন অনেকটাই কোণঠাসা। ত্যাগী নেতাদের কোনো মূল্যায়ন নেই দলে। নেতৃত্ব ও ক্ষমতা এখন হাইব্রিড নেতৃত্বের কব্জায়। উড়ে এসে জুড়ে বসা এসব নেতার দলে আবেদন না থাকলেও ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কর্মীদের কাছে তারা বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। অনেকেই ব্যস্ত দলীয় পদ-পদবি ব্যবহার করে আখের গোছাতে। এতে দলটিতে অন্তঃকোন্দল বাড়ছে। সংখ্যালঘু থেকে মুক্তিযোদ্ধা পর্যন্ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে। জানা গেছে, ৩০ অক্টোবর নিজ কার্যালয়ে দুর্বৃত্তের হামলার শিকার হন সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল হক। এ০ঘটনায় এমপিসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে তাড়াশ থানায় মামলা হয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানের মধ্যে বিরোধ দীর্ঘদিনের। তবে উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই বলে জানিয়েছেন এমপি গাজী আমজাদ হোসেন মিলন। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আবদুল হক আমার ছোট ভাই। রাজনৈতিক শিষ্য। জাসদ থেকে আওয়ামী লীগে এনে রাজনীতি শিখিয়েছি। তার সঙ্গে ন্যূনতম দ্বন্দ্ব নেই।’ তিনি বলেন, ‘সে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর উপজেলা পরিষদের সন্নিকটেই একটি সরকারি পুকুর দখল করাসহ নানা অনিয়ম করে আসছিল। এ নিয়ে এলাকাবাসী তার বিরুদ্ধে ঝাড়ুমিছিল করেছিল। মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকেই সেদিন ওই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।’ এ বিষয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চেয়ারম্যান আবদুল হক বলেন, ‘এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই দলীয় নেতা-কর্মীদের সাইড লাইনে রেখে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের কাছে ভিড়িয়েছেন গাজী আমজাদ হোসেন মিলন। ছাত্রদল-শিবিরের নেতা-কর্মীরা এমপির প্রতিনিধিত্ব করে। দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা-কর্মীরা উপেক্ষিত। ফলে তার জনপ্রিয়তা দিন দিন শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। অন্যদিকে দলের সব পর্যায়ে আমার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠছেন। তিনি ভবিষ্যৎ কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রাখতে চান না। সে কারণেই আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে দিয়েছিলেন।’ অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি ছাত্রলীগ-যুবলীগের সভাপতি ছিলাম। আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক থেকে এমপির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ভোটের মাধ্যমে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছি।’ যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্যে। ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবস জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন ও সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার পৃথকভাবে পালন করেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন উপলক্ষে জেলা আওয়ামী লীগের ডেলিগেট ও কাউন্সিলর পাঠানোসহ প্রস্তুতি বৈঠক আহ্বান করেন জেলা সভাপতি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না। স্থানীয় নেতা-কর্মীরা জানিয়েছেন, জেলার দুই শীর্ষ নেতার প্রকাশ্য বিরোধে নেতা-কর্মীরাও বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। কোন্দল নিরসনে দ্রুত কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন স্থানীয়রা। সাতক্ষীরা জেলায় এমপি-নেতাদের দ্বন্দ্ব আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সদর আসনের এমপি মীর মোস্তাক আহমেদ রবির সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মাছ-দা সম্পর্ক। সভাপতি ও জেলা পরিষদের প্রশাসক মনসুর আহমেদের সঙ্গে জেলা ক্রীড়া সংস্থার নির্বাচন নিয়ে এমপির দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। নির্বাচনে তারা দুজন দুই গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন। এর আগে বিরোধ থাকলেও এভাবে প্রকাশ্যে আসেনি। অন্যদিকে সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলামের সঙ্গে বিরোধ দলীয় মনোনয়ন নিয়ে বলে জানা গেছে। তিন নেতার বিরোধের কারণে জেলা সদরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগ। পিরোজপুরে জেলা সভাপতি ও সদর আসনের এমপি এ কে এম এ আউয়ালের একক নিয়ন্ত্রণে থাকা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এখন বিরোধ শুরু হয়েছে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ নয়, নিজ ভাই। এ কে এম এ আউয়ালের মেজো ভাই পিরোজপুর পৌরসভা মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হাবিবুর রহমান মালেক, সেজো ভাই উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান খালেক, ছোট ভাই মশিউর রহমান মহারাজ বাস মালিক সমিতির সভাপতি। সম্প্রতি এ তিন ভাইয়ের সঙ্গে গৃহবিবাদ জেলা আওয়ামী লীগেও কোন্দলে রূপ নিয়েছে। এ তিন ভাইয়ের সঙ্গে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাকিম হাওলাদার। সেপ্টেম্বরে জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্র। এ কমিটির সভাপতি হন এমপি আউয়াল। সাধারণ সম্পাদক হাকিম হাওলাদার এবং তিন ভাই এমপি আউয়ালকে ছাড়াই টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজার জিয়ারতে যান। এ সময় কমিটির ৭৪ সদস্যের মধ্যে সাধারণ সম্পাদকসহ ৫৪ জন নেতা একত্রে ছিলেন। এ ঘটনার পর এ কে এম এ আউয়াল পিরোজপুর সদর থানায় সাধারণ সম্পাদক হাকিম হাওলাদার ও দুই ভাইসহ মোট চারজনের নামে একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।

ঝিনাইদহ জেলা-উপজেলায় আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দল চরম আকার ধারণ করেছে। এ কারণে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড এখানো শক্তিশালী হতে পারেনি। জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনেক আগে সম্পন্ন করা হলেও পাঁচটি উপজেলায় এখনো সম্মেলন করা হয়নি। এ কারণে উপজেলা আওয়ামী লীগ বিভিন্ন গ্রুপ-উপগ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। শৈলকূপা উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন করা হলেও কোন্দল নিরসন হয়নি। বরং সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কোন্দল আরও বেড়েছে। অনেক নেতা-কর্মীকে একঘরে ও কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। সম্প্রতি এলজিইডির টেন্ডার ড্রপ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা প্রবীণ আওয়ামী লীগে নেতা মোক্তার আহম্মেদ মৃধা ও তার ছেলে গোলাম মুরশিদ মৃধাকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দিয়েছেন শৈলকূপা আসনের এমপি গ্রুপের নেতা-কর্মীরা। এ নিয়ে শৈলকূপা আওয়ামী লীগের মধ্যে চলছে চরম উত্তেজনা। হরিণাকুণ্ডুতে একই অবস্থা। সেখানে মশিয়ার জোয়ার্দ্দার ও আফজাল হোসেন গ্রুপে আওয়ামী লীগ বিভক্ত।

ঝিনাইদহ-৩ (কোটচাঁদপুর-মহেশপুর) আসনেও দুটি গ্রুপ সক্রিয়। একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বর্তমান এমপি নবী নেওয়াজ এবং অপর গ্রুপের সাবেক এমপি শফিকুল আজম খান চঞ্চল। কালীগঞ্জ উপজেলায় দ্বন্দ্ব চরমে। এক গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার। অন্য গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক এমপি আবদুল মান্নান। তাদের দুজনের মধ্যে দা-কুমড়া সম্পর্ক। এ কারণে সাম্প্রতিক সময়ে এক নেতাকে প্রাণ দিতে হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর