বুধবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

যুক্তরাজ্য সোনালী ব্যাংকের শাখাগুলো ধরে রাখার চেষ্টা

নিজস্ব প্রতিবেদক

লন্ডনে প্রবাসী নাগরিক বাংলাদেশের ডেমরার সারুলিয়ার বাসিন্দা তুহিন ছয়-সাত বছর হলো একটি রেস্টুরেন্টে চাকরি করছেন। গ্রামের বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা ও মায়ের জন্য টাকা পাঠাতে সম্প্রতি সেখানকার একটি ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে গেলে তাকে বলা হলো, তার আয়ের উৎস ও আয়-ব্যয়ের হিসাব সত্যায়িত করে তারপর আবার আসতে। কিন্তু তিনি সেখানে চাকরির পাশাপাশি একটি ব্যবসায়ও জড়িত। তাই তার চাকরির সঙ্গে আয়ের সঙ্গতি মেলানো মুশকিল বলে তিনি ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে যথেষ্ট পরিমাণ টাকা পাঠাতে পারছেন না। আবার ব্যাংকে তা জমাও রাখতে পারছেন না। এই হলো লন্ডনে নতুন ব্যাংকিং আইনের কঠোরতা। এ আইনি কঠোরতার কারণে একদিকে প্রবাসীরা যেভাবে সমস্যায় পড়েছেন, একইভাবে অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী সোনালী ব্যাংকের ইউকের ছয়টি শাখা। এরই মধ্যে চারটি শাখা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। লাইসেন্স যেহেতু টিকে আছে তাই বাংলাদেশ সরকার শাখাগুলো আবারও চালু করে ব্যাংকিং চ্যানেল ধরে রাখার উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য ইতিমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় মূলধন হিসেবে ১৫ লাখ পাউন্ড বরাদ্দ দিয়েছে। সেই টাকা ইতিমধ্যে লন্ডনে পৌঁছেও গেছে। লন্ডনের নতুন ব্যাংকিং আইনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেখানকার সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম নতুন করে বাস্তবায়ন করতে পারলেই টিকে যাবে সোনালী ব্যাংকের সেই শাখাগুলো। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক বিভাগের সাবেক সচিব ও বর্তমানে সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেডের বোর্ড চেয়ারম্যান ড. আসলাম আলম বলেন, লন্ডনের ব্যাংকিং আইন সঠিকভাবে মেনে মূলধন বাড়িয়ে ও শাখাগুলো টিকিয়ে রাখা সম্ভব। কারণ সেখানে আইনের বাস্তবায়ন শতভাগ নিশ্চিত হলেই ব্যবসা করতে পারবে শাখাগুলো। তিনি জানান, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর হার কম হলেও সেখানে ট্রেড ফাইন্যান্স করতে পারলে শাখাগুলো টিকে যাবে। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শুধু আর্থিক কেলেঙ্কারির জন্যই যে সাম্প্রতিক সময়ে সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেডকে ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন পাউন্ড জরিমানা দিতে হয়েছে তা নয়, মূলত ২০১০ সালে লন্ডনের আগের ব্যাংক রেগুলেটরি অথরিটি এফএসএর নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করার কারণেই ওই জরিমানা করা হয়। এখানে কোনো মুদ্রা পাচারের ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি সোনালী ব্যাংকের। এফসিএর তখনকার নির্দেশনা ছিল, যাতে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে সতর্ক থাকে সোনালী ব্যাংক।

সূত্র জানায়, অনিয়মের অভিযোগে সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেডের দুটি শাখা বন্ধ হয়ে গেছে। আরও একটি শাখা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আরেকটি শাখাকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মৌখিকভাবে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকটিতে খোলা হচ্ছে না নতুন কোনো হিসাব। বাংলাদেশ সরকার ও সোনালী ব্যাংকের যৌথ মালিকানায় যুক্তরাজ্যে পরিচালিত এ ব্যাংকটি গত বছর লোকসানে পড়েছে। এর পরও নতুন করে দেশ থেকে আরও ৩৫০ কোটি টাকা সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে ব্যর্থ হওয়ায় যুক্তরাজ্যের ফিনানশিয়াল কনডাক্ট অথরিটি (এফসিএ) এই জরিমানা করে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংক ইউকে শাখাকে নতুন গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত গ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এ ছাড়া ছয় মাসের (২৪ সপ্তাহ) জন্য এ নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ থেকে জরিমানার টাকা পরিশোধ করা হলেও নির্ধারিত ২৪ সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

যুক্তরাজ্যের রেগুলেটরি অথরিটি প্রতিষ্ঠান এফসিএ বলেছে, সোনালী ব্যাংক ইউকে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছে। এ জন্য ব্যাংকটিকে ৩৩ লাখ পাউন্ড জরিমানা করা হয়েছে। ব্যাংকটি প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স বাংলাদেশে পাঠাতে পারবে। এফসিএর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে ব্যাংকটি ব্যর্থ হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সম্ভাব্য মুদ্রা পাচার ঠেকাতে পদ্ধতি উন্নত করতে সোনালী ব্যাংককে ২০১০ সালে সতর্ক করেছিল এফসিএ। মানি লন্ডারিং আইন সিস্টেমের পরিপূর্ণ পরিচালন না করায় এ জরিমানা করা হয়। যুক্তরাজ্যের লন্ডনে, বার্মিংহাম ও ব্রাডফার্ডে সোনালী ব্যাংকের তিনটি শাখা রয়েছে। প্রবাসীদের সেবা দিতে ও ঋণপত্রের নিশ্চয়তা প্রদানের জন্য ২০০১ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাজ্যে যাত্রা শুরু করে সোনালী ব্যাংক। জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেডের সাবেক সিইও ও বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক রূপালী ব্যাংক লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর অ্যান্ড সিইও মো. আতাউর রহমান প্রধান বলেন, তিনি সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেডে প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করেন ২০১২ সালের ১১ এপ্রিল থেকে ২০১৫ সালের ৮ মে পর্যন্ত। তার যোগদানের আগে সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেডের ছয়টি শাখার মধ্যে মাত্র দুটি শাখা লাভজনক ছিল। বাকি চারটি শাখাই ছিল লোকসানে। তিনি আরও দুটি শাখা লাভজনক এবং অন্য দুটি শাখার লোকসান উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনেন। আতাউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সম্প্রতি বিভিন্ন মিডিয়ায় তার সময়ে দুর্নীতির কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে তার সময়ে আগেরকার সব দুর্নীতি উদ্ঘাটিত হয়েছে। তার সময়ে ওল্ডহাম শাখার ম্যানেজারকে অবসর দেওয়ার ফলে ২০১১ সালে সংঘটিত দুর্নীতি উদ্ঘাটিত হয়। তিনি বলেন, ‘এখন লন্ডনের আইন কঠোর হওয়ায় আমরা আগের নিয়মে ব্যাংক চালাতে পারব না। তবে ব্যাংকটি টিকিয়ে রাখতে হলে সে দেশের নিয়মকানুন পরিপূর্ণভাবে মেনে চলতে হবে।’

সর্বশেষ খবর