এমপি আবুল কালাম আজাদের মানববন্ধন ও সভার পর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল পল্লীতে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে, সরকারি ত্রাণ ফিরিয়ে দিলেও বেসরকারি ত্রাণ নিতে আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন সাঁওতালরা।
যুব ইউনিয়ন ও কৃষক সমিতি গাইবান্ধা জেলা শাখা গতকাল ইক্ষু খামারের উচ্ছেদ অভিযানে ক্ষতিগ্রস্ত ২০০ সাঁওতাল পরিবারের মাঝে হাঁড়ি-পাতিল, থালা-গ্লাস-চামচ বিতরণ করেছে। তবে ১০ দিন ধরে দুই শতাধিক পরিবার মাদারপুর চার্চের খোলা প্রাঙ্গণ ও চার্চের পরিত্যক্ত স্কুল ভবনে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। সোমবার চিনিকলের শ্রমিক ইউনিয়নের মানববন্ধন এবং সাপমারা ও কাটাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সৌহার্দ সম্পর্ক বিষয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর সাঁওতাল পল্লীতে আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়। আদিবাসী ছাত্র ফেডারেশনের গোবিন্দগঞ্জ শাখার সাবেক সভাপতি রতন মারডি জানান, সোমবার চিনিকলের শ্রমিকরা গোবিন্দগঞ্জে মানববন্ধন করে এবং ফার্মের কাটা এলাকায় সাপমারা ও কাটাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের যৌথ আয়োজনে আদিবাসী ও বাঙালি মুসলমানদের সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বিষয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করে। সে সভায় গোবিন্দগঞ্জ আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ প্রধান অতিথি ছিলেন। ওই মানববন্ধন ও সভায় আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়। তাই সাঁওতাল পল্লীতে নতুন করে আতঙ্ক জেঁকে বসেছে। এলাকায় পুলিশ দেখলেই সবাই সরে পড়ছে। কারণ ৬ নভেম্বর জমি থেকে উচ্ছেদের পর পুলিশ গোবিন্দগঞ্জ থানায় আমাদের বিরুদ্ধে যে মামলা করেছে সেখানে ৩৫০ জনকে আসামি করা হয়। তাই সবাই গ্রেফতার আতঙ্কে ভুগছে। এদিকে মাদারপুর চার্চ প্রাঙ্গণে যুব ইউনিয়ন ও কৃষক সমিতির ত্রাণসামগ্রী নিতে আসা জ্যোত্স্না মুরমু ও রোজিনা সরেন বলেন, সরকার এবং এমপি ছাড়া অন্য সবার সাহায্য আমরা নেব। ত্রাণ বিতরণে আসা যুব ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রতিভা সরকার ও কৃষক সমিতি গাইবান্ধা জেলা শাখার সভাপতি সুভাষ শাহ রায় বলেন, সাঁওতাল পল্লীর অধিবাসীদের উচ্ছেদের সময় বাড়িঘরসহ হাঁড়ি-পাতিল-থালা- গ্লাস সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তারা কলাপাতায় খাবার খাচ্ছে এবং রান্না করতে পারছে না বলে আমরা হাঁড়ি-পাতিল থালা গ্লাস বিতরণ করেছি।
উচ্ছেদের বিষয়ে জানতে সাঁওতালদের নোটিস : গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে রংপুর চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণ করা জমি থেকে কোন কর্তৃত্ব বলে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করা হয়েছে তা জানতে প্রশাসনকে আইনি নোটিস পাঠিয়েছে দুই সাঁওতাল পরিবার। উচ্ছেদের সময় তাদের ওপর হামলা, লুটপাট এবং হত্যাকাণ্ডে দোষীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে নোটিসে তাও জানাতে বলা হয়েছে। হামলায় আহত সাঁওতাল দ্বিজেন টুডোর স্ত্রী অলিভিয়া হ্যামভ্রম এবং গণেশ মুরমোর স্ত্রী রুমিলা কিসকুর পক্ষে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী জ্যোর্তিময় বড়ুয়া গতকাল রেজিস্ট্রি ডাকযোগে এ নোটিস পাঠান। নোটিস পাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জবাব না পেলে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্র সচিব, শিল্প সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক, পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি, গাইবান্ধার পুলিশ সুপার, গোবিন্দগঞ্জের ইউএনও ও ওসি এবং রংপুর সুগার মিলের ব্যবস্থাপককে নোটিস পাঠানো হয়েছে।গোবিন্দগঞ্জে ত্রিমুখী সংঘর্ষ দুই সাঁওতালকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ : গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারে পুলিশের ওপর হামলা, তীর নিক্ষেপ ও সরকারি কাজে বাধা প্রদান মামলায় চিকিৎসা শেষে দুই সাঁওতালকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে আদালত। গতকাল বিকেলে গোবিন্দগঞ্জ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক তাসকিনুল হক এ আদেশ দেন। গোবিন্দগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুব্রত কুমার সরকার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, বিকেলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (এসআই) আজাদ আটক দুই সাঁওতাল দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলার কুচাপাড়ার শাকিলা কিসকুর ছেলে বিমল কিসকু ও রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার লোহানীপাড়ার মৃত জঙ্গা সরেনের ছেলে চরণ সরেনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (রমেক) চিকিৎসা শেষে আদালতে হাজির করেন। পরে বিচারক শুনানি শেষে তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। উল্লেখ্য, ৬ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের আখ কাটায় বাধা প্রদানকে কেন্দ্র করে খামারের জমি দখলকারী আদিবাসী সাঁওতালের সঙ্গে শ্রমিক-কর্মচারী ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়। এ সময় সাঁওতালদের নিক্ষিপ্ত তীরের আঘাতে ৯ পুলিশ তীরবিদ্ধসহ অন্তত ৩০ জন আহত হয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে গোবিন্দগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করে।
সাঁওতাল পল্লীতে হামলার বিচার চাইল আদিবাসী নেতারা : গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লীতে হামলার ঘটনায় সুষুম তদন্ত দাবি করেছেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নেতারা। গতকাল সন্ধ্যায় ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে এই দাবি জানান তারা।
প্রবীণ রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য ও জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্র নাথ স্বরন আদিবাসীদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন। এ সময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, প্রেসিডিয়াম সদস্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, মাহবুব-উল আলম হানিফ, বি এম মোজাম্মেল হক, এ কে এম এনামুল হক শামীম, ফরিদুন্নাহার লাইলী, সুজিত রায় নন্দী, আমিনুল ইসলাম আমিন, বিপ্লব বড়ুয়া, ইকবাল হোসেন অপুসহ দলের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে আদিবাসী পরিষদের নেতারা সাঁওতাল পল্লীতে হামলার ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেন। এ সময় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু বিচার ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশ্বাস দেওয়া হয়।
অন্যদিকে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলার ঘটনায় স্থানীয় হিন্দু নেতারাও আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন।