বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

যারা সাঁতার কাটছে তারা মানবী

সমরেশ মজুমদার

যারা সাঁতার কাটছে তারা মানবী

জলপাইগুড়ির সেনপাড়ার শেষে তিস্তার গায়ে একটা ছোট্ট বসতি ছিল। ওদের পুরুষেরা শহরে যেত মজুরের কাজ করতে। মেয়েরা পুরো বর্ষাকাল তিস্তায় সাঁতার কেটে ভেসে যাওয়া গাছ ধরত। সেই গাছ স্রোতের সঙ্গে লড়াই করে তীরে নিয়ে এসে কুড়ুল দিয়ে কেটে শুকোত। তারপর সেই শুকনো কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি করত। খুব বেশি হলে গোটা পনেরো বাখারি আর চ্যাটাই ঘেরা ঘরে ছিল ওদের বাস। নিজস্ব জমিজমা না থাকায় চাষ করে খাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। আমাদের তখন উঠতি বয়স। সবে ঠোঁটের ওপরের লোম কালচে হচ্ছে। পুজোর আগে তিস্তার চর যখন কাশবনে ছেয়ে যেত তখন তার আড়ালে বসে জল দেখতে দেখতে প্রথম সিগারেট খাওয়ার দীক্ষা হয়েছিল। সেরকম এক ছুটির দুপুরে আমি এবং আমার বন্ধু মন্টি মত্স্যকন্যাদের দেখেছিলাম। মত্স্যকন্যার ছবি দেখেছিলাম বইয়ের পাতায়, ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, কোমরের নিচের অংশ মাছের। তিস্তার জল তখনো গভীর তবে স্রোত গম্ভীর। ওই জলে মত্স্যকন্যা কীভাবে এলো ভাবতেই ভুল ভাঙল। যারা সাঁতার কাটছে তারা মানবী। মাঝনদীতে ভেসে যাওয়া গাছ ধরার জন্য তারা এত আকুল যে ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত হয়ে গেলেও তা আমল দিচ্ছে না। দৃশ্য দেখে আমরা খুব লজ্জা পেয়ে চোরের মতো নিঃশব্দে চর ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু আমরা দুজনই একটা অপরাধবোধের শিকার হলাম। আমরা যদিও ওই মেয়েদের দেখতে নদীর কাশবনে যাইনি কিন্তু ওদের শরীর যে দেখে ফেলেছি। সেই সময় শরত্চন্দ্র প্রায় শেষ করেই, ‘বিটি রোডের ধারে’ বা ‘শ্রীমতী কাফে’ পড়া হয়ে গিয়েছে।

মন্টিই কথাটা বলল, ‘তোর কি মনে হচ্ছে ওরা আমাদের দেখে ফেলেছে?’

আমি নিশ্চিত ছিলাম না। কয়েকটা কাশগাছ আমাদের সামনে আড়াল করে ছিল।

দুদিনের মধ্যে যখন কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না তখন মন্টি বলল, ‘আমি খোঁজ নিয়েছি, ওরা খুব গরিব। নিজেদের ঘরবাড়ি নেই। থাকে সেনপাড়ার শেষে তিস্তার গায়ে। এক কাজ করবি? ক্লাসের সবার কাছ থেকে পুরনো জামা-প্যান্ট চেয়ে নিয়ে ওদের ছেলেমেয়েদের জন্য দিয়ে আসবি?’

নিশ্চয়ই একটা অপরাধবোধ তখনো বেঁচে ছিল। নইলে দ্রুত জামা-প্যান্ট সংগ্রহ করতে নেমে পড়লাম কেন? যেসব বন্ধুর বোন আছে তাদের পুরনো জামাও পাওয়া গেল। প্রায় শদেড়েক জামা-কাপড় একটা ভ্যানুরিকশায় চাপিয়ে তিস্তার পাড় ধরে হেঁটে হাজির হলাম ওদের আস্তানায়। আমাদের দেখে মেয়েরা অবাক চোখে তাকাল। বাচ্চারা এগিয়ে এলো সামনে। মন্টি বলল, ‘তোমাদের জন্য এই জামা-কাপড় এনেছি।’

একজন প্রবীণ দূরে দাঁড়িয়েই বললেন, ‘দাম দিতে পারব না।’

‘না না দাম দিতে হবে না। এমনি, ভালোবেসে দিচ্ছি। একটু পুরনো হয়ে গেলেও ছেঁড়া নেই। আপনারা নিন।’

তবু মেয়েরা এগিয়ে আসছিল না। হয়তো আমাদের উদ্যোগকে সন্দেহ করছিল। এ সময় একতারা বাজিয়ে এক প্রৌঢ়কে আসতে দেখলাম। ভ্যানওয়ালা তাগাদা দিল, ‘বলেছিলেন, এখানে মাল নামিয়েই চলে যেতে পারব। মাটিতে নামিয়ে রাখি?’

ততক্ষণে প্রৌঢ় কাছে এসে গিয়েছেন। একমুখ কাঁচাপাকা দাড়ি, মাথার লম্বা চুলে একফালি কাপড়ের ফেট্টি বাঁধা। পরনে লুঙ্গির ওপর ফতুয়া। এসে জিগ্যেস করলেন, ‘কী বিক্রি হচ্ছে? বাবুরা কী বিক্রি করতে এসেছেন?’

মন্টি রেগে গেল, ‘বিক্রি করতে আসিনি। এখানকার বাচ্চাদের, ছেলেমেয়েদের জন্য জামা-কাপড় নিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু ওঁরা নিতে চাইছেন না।’

‘কেন আনলেন ভাই? হঠাৎ দয়া জাগল মনে?’

‘দয়া নয়। ভালোবেসে নিয়ে এসেছিলাম।’

‘তাই বলুন। ও মা-বোনেরা, তোমরা কী গো? ভালোবাসা বোঝ না? এই বাবুরা কত কষ্ট করে এসব নিয়ে এসেছেন বুকে ভালোবাসা এসেছে বলে, আর তোমরা হাত বাড়াতে পারছ না? এসো, এগুলো নামিয়ে রাখ, তারপর যার যেমন দরকার দিয়ে দাও।’

কাজ হলো ওর কথায়। হাতে হাতে নেমে গেল জামা-কাপড়গুলো। ভ্যানওয়ালা আগেই চারআনা নিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে সে ফিরে গেল।

সেই বয়স্কা এগিয়ে এলেন, ‘কী করে বুঝব মনের কথা? আমাদের ঘর নেই, পেটে ভাত নেই, পরনে দু’খানা কাপড় নেই তবু কেউ তো দ্যাখে না। আপনারা হঠাৎ সাহায্য করতে এলে মনে সন্দেহ জাগে। কিছু মনে করবেন না।’

এতে আমরা খুশি হয়েছিলাম। প্রৌঢ় বললেন, ‘আসুন বাবুরা, আমরা ওই গাছতলায় একটু বসি।’

একটা আমগাছের নিচে বেদির মতো বাঁধানো। প্রৌঢ় সেখানে বসলে মন্টি জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি গান করেন?’

‘আমি করি না, আমাকে দিয়ে করায়।’ প্রৌঢ় হাসলেন, ‘এই আকাশ, মাঠ, নদীর দিকে যখন তাকাই তখন ওরা আমার বুকে সুর পাঠায়। গলা যত খারাপই হোক সেটা খুলে গাইতে বড় সাধ জাগে।’

‘কী গান করেন আপনি?’ জিজ্ঞাসা করলাম।

‘কী গান? যা মনে আসে। এই সেদিন একটা গল্প শুনছিলাম। কোথায় দেশটা জানি না, যার নাম হ্যামলিন, সেখানে একজন বাঁশিওয়ালা এমন বাঁশি বাজাত যে সমস্ত ইঁদুর তার পেছন পেছন দৌড়তে লাগল। আপনারা কি গল্পটা শুনেছেন?’

দুজনেই মাথা নাড়লাম ,‘হ্যাঁ’।

‘সেই গল্প শুনে মনে প্রশ্ন এলো। লোকটা যদি আমাদের দেশে আসত? আর প্রশ্নটা আসা মাত্র গান তৈরি হয়ে গেল। শুনবেন?’

উত্সুক হয়ে সম্মতি জানালে প্রৌঢ় চোখ বন্ধ করে একতারায় সুর তুলতে লাগলেন। তার গলা খুলে গাইলেন।

গলা ভালো নয় কিন্তু কথার সঙ্গে আবেগ মিশে যাওয়ায় অনবদ্য লাগছিল। গান শেষ হলে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘লোকটা কি উত্তর পেয়েছিল?’

প্রৌঢ় বললেন, ‘অন্ধের হস্তিদর্শন’ যে যার মতো ব্যাখ্যা করে। যদি ডুবে দেখতে চান বাবু তা হলে কোনো তল পাবেন না। তাই সবাই ওপরে ওপরে ভেসে থাকে, দিব্যি দিন কেটে যায়, পুঁটিমাছের যেমন কাটে। কথাগুলো বলেই খেয়াল হলো, গলা তুলে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদের উদ্দেশে বললেন, ‘ক গো তোমরা? এরা এলেন, তোমাদের জন্য ভালোবাসা বয়ে নিয়ে এলেন, আর তোমরা ওগুলো ডাঁই করে রেখেছ? অঙ্গে ধারণ করে দেখিয়ে দেবে না?’

প্রৌঢ়র নির্দেশে সমস্ত জামা-কাপড় নিয়ে ওরা আড়ালে চলে গেল। একটা কুচোও তখন সামনে নেই। তারপর সেই অপূর্ব দৃশ্য দেখলাম। যেসব শিশু বালক-বালিকা এতক্ষণ আদুর গায়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের পরনে রঙিন পোশাক। সেই পোশাকে ওদের মুখ হাসিতে ভরে গিয়েছে। প্রৌঢ় খুশিতে দাড়ি দোলালেন, ‘এসো এসো, লাইন দিয়ে দাঁড়াও সবাই। আহা, দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে গো।’ বাচ্চাদের পেছনে এসে দাঁড়াল কিশোরী এবং কয়েকজন যুবতী। আমার বন্ধুদের বোন, দিদি বা মায়ের পুরনো জামা এখন ওদের অঙ্গে। প্রৌঢ় তার পাশে রাখা ঝোলা এগিয়ে ধরলেন, ‘নাও, আজ দুটো টাকা কপালে জুটেছিল। তাই দিয়ে মুড়ি কিনে এনেছি সবার জন্য। সবাইকে এক-দুই মুঠো করে ভাগ করে দাও। এই বাবুদেরও দিও। আজ, বাবুরা, আমাদের মুড়িমুখ হোক।’

সর্বশেষ খবর