শুক্রবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ইউটিউবে ভিডিও দিয়ে দেশে ফিরল ওরা ২৫ জন

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

ইউটিউবে ভিডিও দিয়ে দেশে ফিরল ওরা ২৫ জন

আফগানিস্তানে গিয়ে প্রতারিত হয়ে নির্যাতন আর অনাহার-অর্ধাহারে বন্দী জীবন কাটিয়ে অবশেষে দেশে ফিরেছেন ২৫ বাংলাদেশি। তারা আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলীয় হেরাত প্রদেশে একটি ইস্পাত কারখানায় কাজ করতে গিয়েছিলেন। বছর খানেকের বন্দী জীবনের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম-এর সহায়তায় বন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের পর তারা গতকাল সকালে ফ্লাই দুবাইয়ের একটি ফ্লাইটে ঢাকায় পৌঁছেন। তাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইউটিউবে দেওয়া একটি ভিডিওর কারণে। সেই ভিডিওতে দুর্দশার বর্ণনা দিয়েছিলেন এই বাংলাদেশিরা। সেই ভিডিও দেখে আফগানিস্তানে থাকা এক প্রবাসী বাংলাদেশি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইওএম-এর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাদের মুক্তির ব্যবস্থা হয়। গত বছরের ১০ অক্টোবর এই ২৫ বাংলাদেশি চাকরির উদ্দেশে আফগানিস্তানে যান। ঢাকায় ফিরতে পেরে উচ্ছ্বসিত শ্রমিকরা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশে রামপ্রসাদ নামের ভারতীয় এক নাগরিকের সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। ভালো চাকরি ও বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে এই ২৫ জনকে নেওয়া হয় আফগানিস্তানের হেরাত প্রদেশে। সেখানে একটি ইস্পাত কারখানায় চাকরিও দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের ভিসার মেয়াদ ছিল মাত্র এক মাস। ভিসা নবায়ন হবে এই ভরসায় কাজ শুরু করেন শ্রমিকরা। কিন্তু দুই মাস পর ওই কারখানাই বন্ধ হয়ে যায়। পরে তাদের ওই কারখানার ভেতরে আটকে রেখে বিনা বেতনে কাজ করানো হয় বলে তারা অভিযোগ করেন।

দেশে ফেরা মানিকগঞ্জের নবগ্রামের রিপন আলী বলেন, চুক্তি অনুসারে ৫০০ ডলার করে বেতন দেওয়ার কথা ছিল। প্রতিশ্রুতি ছিল ভিসার মেয়াদ শেষে মেয়াদ বাড়াতে সহায়তা করা হবে। দুই মাস ৩০০ ডলার করে দেওয়ার পর মালিক বেতন দেওয়া বন্ধ করে দেয়। ভিসার মেয়াদ পার হয়ে যাওয়ার পর আমাদের কারখানাতেই থাকতে বাধ্য করা হয়। বাইরে বের হওয়ার কোনো উপায় ছিল না। কারখানার বাইরে লোকজন পাহারায় থাকত।

টাঙ্গাইলের সোহেল রানা জানান, কয়েক মাস খুব বাজে খাবার খেয়ে থাকতে হয়েছে। ছোলা, বুট, নিম্নমানের রুটি খেতে দেওয়া হতো। মালিক না আসায় কারখানা ভালো চলত না। তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ফল হয়নি। পরে বন্দীদশায় থেকেই গত ২৯ জুলাই মোবাইল ফোন থেকে ইউটিউবে একটি ভিডিও প্রকাশ করেন আটকেপড়া একজন। ভিডিওতে মানবেতর জীবনের তথ্য দিয়ে সহায়তা চাওয়া হয়। ভিডিওটি পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আফগানিস্তানের একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা বাংলাদেশি নাগরিক গোলাম আযমসহ কয়েকজনের নজরে আসে। গতকাল বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন সেই গোলাম আযম। তিনি জানালেন, ‘ভিডিওটি দেখার পর সবাই চিন্তা করি, বাংলাদেশি ভাইদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। এরপর সরকারি বিভিন্ন দফতরে যোগাযোগ করি। সহযোগিতায় এগিয়ে আসে আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম)। তারা নিজেদের বাংলাদেশ অফিসে যোগাযোগ করে। পরে সেখান থেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও যোগাযোগ করা হয়।’ আইওএম বাংলাদেশের ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফিসার মোহাম্মদ শাকিল মনসুর জানান, বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিষয়টি পুরো জানার পর তারা সহায়তায় এগিয়ে আসেন। বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনতে আন্তরিকতা দেখিয়েছে। তারা অত্যন্ত ইতিবাচক অবস্থান নেওয়ায় শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অব্যাহত কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে আটকেপড়া ২৫ জন বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন। তারা কাজের উদ্দেশে অবৈধভাবে আফগানিস্তানের হেরাত প্রদেশে গিয়েছিলেন এবং একটি প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেন। কিন্তু ২-৩ মাস পরেই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে স্থানীয় হেরাত কর্তৃপক্ষ আটকেপড়া বাংলাদেশিদের খাবার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। এ লক্ষ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকায় আফগান দূতাবাস ও আফগানিস্তানের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার সঙ্গে প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধন করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে আফগান সরকার আটকেপড়া বাংলাদেশিদের মেয়াদোত্তীর্ণ অবস্থানের ভিসা ফি থেকে অব্যাহতি দেয় এবং পরবর্তীতে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আটকেপড়া বাংলাদেশিদের দেশে আনার ব্যবস্থা করে। ফিরে আসা বাংলাদেশিরা সবাই সুস্থ আছেন এবং তারা দেশে ফিরতে পারায় সরকারকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

সর্বশেষ খবর