শনিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিদেশের কারাগারে দুঃসহ জীবনে বাংলাদেশিরা

জুলকার নাইন

বিদেশের কারাগারে দুঃসহ জীবনে বাংলাদেশিরা

মার্কিন মুল্লুকের টেক্সাসের এল পাসো শহরের একটি কারাগার থেকে নিউইয়র্ক শহরের একটি বাংলা ভাষার সাপ্তাহিক পত্রিকার কার্যালয়ের ঠিকানায় একটি চিঠি লেখা হয় ২০১৫ সালের ২১ মার্চ। মাহবুব রহমান নামের এক বাংলাদেশির এই চিঠি ২৮ মার্চ কারাগারের ডাকঘরে পোস্ট হয়েছিল।

চিঠিতে মাহবুবসহ ৯০ বাংলাদেশির কারাগারের মানবেতর জীবনযাপনের চিত্র তুলে ধরে উদ্ধারে সহায়তা চেয়ে লিখেছিলেন, ‘আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় দেশে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। এখানে আমাদের  খোঁজ নেওয়ার কেউ নেই। খুব অসহায় ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছি আমরা। আশা করি আপনারা সহযোগিতা করবেন।’

এই চিঠির আগে কারও কাছে খবর ছিল না এ হতভাগা বাংলাদেশিদের। চিঠি পেয়ে জানতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ সোসাইটি। তারা দেন আইনি সহায়তা। ইমিগ্রেশন রাইটস নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশি আইনজীবীরা জানান, টেক্সাসের কারাগারেই কেবল নয়, আমেরিকার সীমান্তবর্তী অসংখ্য কারাগারে বাংলাদেশিরা বন্দী অবস্থায় রয়েছেন। তার মধ্যে বেশিরভাগই  টেক্সাসে। এরা ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, পেরু, মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছেন। সবার তথ্য পরিবার বা অন্য বাংলাদেশিদের কাছে নেই। যেমন মাহবুবের চিঠির আগে কারও কাছে খবর ছিল না টেক্সাসের সেই ৯০ জনের। আইনজীবীরা জানান, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় প্রবেশকারী বাংলাদেশিদের মানবিক বিবেচনায় নয়, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত আছে কিনা— সে বিষয়টি নিয়ে দোটানায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট। আইনি কাঠামোতে পাঠাতেও  অনীহা আছে মার্কিনিদের। কারণ আইনি কাঠামোতে পাঠালে তারা যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়িত্বের অনুমতিও পেয়ে যেতে পারে। অবশ্য বিশেষ বিমানে গভীর রাতে তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। সর্বশেষ ১৬৯ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ায় আছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রথম ধাপে ২৭ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানোর পর দ্বিতীয় ধাপে আরও ৪১ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। যারা ফিরেছেন তারা সবাই নিঃস্ব রিক্ত। ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা বাংলাদেশিদের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে অস্বস্তি রয়েছে। অবশ্য এসব বিমানে বাংলাদেশের পাশাপাশি নেপাল, ভারত, পাকিস্তানের নাগরিকও ছিল। একই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি দেশের নাগরিককে নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র থেকে ছেড়ে আসা বিমান সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকদের নামিয়ে দিয়ে ফেরত যায়। প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো বলছে, এই সমস্যা শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয় বিশ্বের ৪২টি দেশে ১৩ হাজারের বেশি বাংলাদেশি বন্দী হয়ে আছেন। আর সংখ্যাও প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। কারণ প্রতিদিনই প্রচলিত ও অপ্রচলিত পথে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন বাংলাদেশিরা। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় তারা বৈধ পথের পাশাপাশি যাচ্ছেন অবৈধ পথেও। অনেকেই গিয়ে আটক হচ্ছেন সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে।

আবার অনেকে মেয়াদ শেষে বাড়তি অবস্থান করে অবৈধ হয়ে যাচ্ছেন। বেশির ভাগই লুকিয়ে থেকে কাজ করছেন। কেউ কেউ গ্রেফতার হচ্ছেন। আবার কোনো কোনো বাংলাদেশি জড়িয়ে পড়ছেন অপরাধে। প্রবাসের মাটিতে চুরি, মাদক পাচার থেকে শুরু করে রোমহর্ষক খুন পর্যন্ত করছেন বাংলাদেশিরা। অবশেষে ঠাঁই হচ্ছে বিদেশের কারাগারে। দূতাবাস কর্তাদের দাবি, সবসময়  কতজন বাংলাদেশি বিদেশের কারাগারগুলোয় বন্দী বা আটক আছেন—তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। আটকদের পক্ষ থেকেই সংশ্লিষ্ট দেশগুলোয় বাংলাদেশ মিশনে যোগাযোগ করলেই কেবল তাদের খোঁজ রাখা সম্ভব হয়। অনেক দেশে নেই মিশনও। তাই তালিকার বাইরেও থেকে যান অনেক বন্দী। তবে খোঁজ পেলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। উদ্ধারের গতি শ্লথ হলেও চেষ্টা ও উদ্যোগ উভয়ই আছে সরকারের। সংসদে জানানো তথ্য অনুযায়ী, বিদেশে বন্দী বাংলাদেশির সংখ্যা ১৩ হাজার ২৪ জন। এর মধ্যে আটক বা বিচারাধীন বাংলাদেশিদের মধ্যে ভারতে রয়েছেন ৩ হাজার ৯৩২ জন।

এ ছাড়া মালয়েশিয়ায় ৩ হাজার ৫৩৬, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১ হাজার ৫৮৪, সৌদি আরবে ৯৯২, ওমানে ৯১২, কাতারে ৪৪৭, বাহরাইনে ৩৭০, যুক্তরাজ্যে ২৫৪, মিয়ানমারে ১৫৮, গ্রিসে ১০৪, মেক্সিকোয় ৯৭, সিঙ্গাপুরে ৮৭, যুক্তরাষ্ট্রে ৬৪, জর্ডানে ৬১,  লেবাননে ৪৯, চীনে ৪৮, ইরাকে ৪৮, ইতালিতে ৪৬, ফ্রান্সে ৪৬, ইরানে ৩২, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৩০, পাকিস্তানে ২২, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৬, নেপালে ১৩, জাপানে ১২, শ্রীলঙ্কায় ১১, জর্জিয়ায় ৮, বুলগেরিয়ায় ৭, আজারবাইজানে ৬, থাইল্যান্ডে ৫, মরিশাসে ৫, মিসরে ৫, ব্রুনাইয়ে ৫, কেনিয়ায় ৪, তুরস্কে ৩, লিবিয়ায় ৩ ও  বেলজিয়ামে দুজন বাংলাদেশি বন্দী আছেন। তবে বাংলাদেশি বন্দীর প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। কেননা দুর্গম পথে ইউরোপে পাড়ি দিতে গিয়ে আফ্রিকার দেশগুলোয় বন্দী হওয়া অনেকের তথ্যই পাওয়া যায় না। সেখানকার অনেক দেশে নিয়মতান্ত্রিক কারাগারের কাঠামোই নেই। সেখানে হয়তো কোনো ঘরের মধ্যে আটকে রাখা হয় গ্রেফতার হওয়া ভাগ্যান্বেষীদের। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সম্প্রতি জানিয়েছেন, বিদেশে বন্দী থাকাদের নিয়ে সরকার দায়িত্বের সঙ্গে কাজ করছে। এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে সুফলও পাওয়া গেছে। সবার জন্যই আইনিসেবা নিশ্চিত করতে দূতাবাসগুলো কাজ করে যাচ্ছে।

সর্বশেষ খবর