শনিবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ডাক্তার সেজে আয়া করলেন অপারেশন

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা এলাকার ‘মাদার্স কেয়ার অ্যান্ড জেনারেল হাসপিটাল’। এই হাসপাতালে গত মাসে এসেছিলেন গৃহবধূ কুলসুমা বেগম (২০)। তার মল-মূত্র পরীক্ষা করে ডাক্তাররা বললেন, গর্ভের সন্তানের অবস্থা ভালো নয়। মা ও বাচ্চাকে বাঁচাতে হলে এখনই অস্ত্রোপচার করতে হবে। নইলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে দুজনেরই মৃত্যু। কুলসুমার স্বজনরা সম্মতি দিলেন। অপারেশন হলো। সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনাকালে কুলসুমা বলেন, ‘ডাক্তররে হাতে ধরছি, মা ডাকছি-আল্লার দোহাই দেয়া কইছি, আমি আর সইবার পারতাছি না আমারে ছাইরা দেন। ডাক্তর আমার মুহের ভিতর মোবাইল ফোন ডুহাইয়া দেয়া আত-পাও বাইন্ধা আমার তলপেট কাটছে। আমি খালি চিক্কুর পাইরা আল্লারে ডাকছি।’ কুলসুমা যাকে ‘ডাক্তর’ বলে উল্লেখ করলেন তার নাম শিমু ইসলাম। তিনি ডাক্তার নন। তিনি আসলে এই হাসপাতালের আয়া। স্থানীয়রা জানান, আয়া দিয়ে, সুইপার দিয়ে অপারেশন করানোর ব্যাপারে হাসপাতালটি ‘নাম’ করেছে। কুলসুমের পেট কেটে একটা কন্যাসন্তান বেরও করা হয়েছে। কিন্তু তার অসুস্থতা কাটে না। তার গরিব স্বামী আসাদুল ও আত্মীয়রা দেখেন ১৭ অক্টোবর অস্ত্রোপচারের পর প্রসুতির রক্তক্ষরণ থামছে না। স্বজনরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাড়াতাড়ি করে পেট সেলাই করে দেওয়া হয়। এরপর থেকে শুরু হলো কুলসুমা পেটে অবিরাম যন্ত্রণা। এক পর্যায়ে ওইদিন সন্ধ্যায় কুলসুমাকে রিলিজ করে দেওয়া হয়। ব্যথার তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে কুলসুমাকে আবার ২৪ অক্টোবর ওই হাসপাতালে ভর্তি করে দুদিন চিকিৎসা করা হয়। কোনো উন্নতি না হাওয়ায় কুলসুমার বাবা খলিল ২৬ অক্টোবর মেয়েকে ময়মনসিংহ শহরে নিয়ে ‘রাজধানী হাসপাতাল’-এ ভর্তি করেন। সেখানে ডাক্তাররা আবার পেট কেটে ‘গজ কাপড়’ বের করেন। ওই হাসপাতালের ডাক্তার মোশারফ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সময়মতো অপারেশন না হলে কুলসুমাকে বাঁচানো যেত না। তবে তিনি এখনো আশঙ্কামুক্ত নন। জানা গেছে, মাদার্স কেয়ার হাসপাতালের মালিক ডা. জহিরুন্নেছা রেনু। ভুয়া ডাক্তার দিয়ে অপারেশনের ফলে এক রোগীর মৃত্যু হলে সিভিল সার্জন অফিস এখানে অভিযান চালায়। এ সময় দেখা যায়, রোগীর প্রেসক্রিপশন, ডিসচার্জ সার্টিফিকেট ইত্যাদি কাগজে শুধু ডা. রেনুর নাম লেখা। অর্থাৎ তিনি ছাড়া এখানে পাস করা ডাক্তার নেই। এর ফলে কিছুদিন আগে ভুল চিকিৎসায় দুই নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন। সিভিল সার্জন অফিস হানা দেওয়ার পর থেকে ভুয়া ডাক্তাররা গা-ঢাকা দিয়েছে।

কুলসুমার বাবা দরিদ্র কৃষক খলিল জানান, মেয়ের চিকিৎসায় দেড় মাসে তিনি দুই লাখ টাকা খরচ করেছেন। ধার-দেনায় তিনি এখন নিঃস্ব। এখন তার কাছে নিয়তি একমাত্র ভরসা। কপাল চাপড়ে কুলসুমার স্বামী আসাদুল বলেন, ‘কোন ডাক্তার যেন আমার স্ত্রীর মত এই রহম সর্বনাশ আর কেউরে না হরে।’ এদিকে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ অস্বীকার করে ডা. জহিরুন্নেসা রেনু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আপনারা শুধু সমস্যা দেখেন। ভালো কাজ যে করি তা দেখেন না। হাসপাতালে শত শত রোগীর অপারেশন করা হয়। এর মধ্যে দু-একটিতে সমস্যা তো হতেই পারে। এটা কোনো বিষয় নয়। আমরা রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে, আপসরফা করেছি। তিনি স্বীকার করেন, কুলসুমাকে আমি অপারেশন না করলেও কাগজপত্রে আমার নাম লেখা। কারণ আমি হাসপাতালের মালিক ও চিকিৎসক। আমার হাসপাতালের একজন সিস্টার ওর অপারেশন করেছেন।’

সর্বশেষ খবর