বুধবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

কমছে না পুলিশের অপরাধ

আলী আজম

কমছে না পুলিশের অপরাধ

নানা অপরাধে জড়াচ্ছেন পুলিশের একশ্রেণির সদস্য। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, শ্লীলতাহানি, জমি ও ফ্ল্যাট দখল, গ্রেফতার বাণিজ্য, ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ গ্রহণসহ সব ধরনের অপরাধে তারা বিচরণ করছেন। কনস্টেবল থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাও এসব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। চাকরিচ্যুত, তিরস্কার, সতর্ক, গুরুদণ্ড, লঘুদণ্ডসহ নানা ব্যবস্থা নেওয়া হলেও পুলিশের অপরাধপ্রবণতা কমছে না। বরং দিন দিন বাড়ছেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কতিপয় পুলিশ সদস্য অপরাধে জড়ালেও এর দায় নিতে হচ্ছে গোটা পুলিশবাহিনীকে। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার অপরাধে জড়িত সদস্যদের সতর্ক করেছেন। তিনি অপরাধ রোধে বেশ কয়েকটি নির্দেশনাও জারি করেন।

পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ থেকে ২০১৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত ছয় বছরে নানা অপরাধে জড়িত থাকায় ৭৬ হাজার ৪২৬ জন পুলিশকে অর্থদণ্ড, তিরস্কার, বদলি, বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক অবসর ও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। শাস্তি পাওয়াদের মধ্যে ৭৬ হাজার ৯৯ জনই কনস্টেবল থেকে উপপরিদর্শক (এসআই) পদমর্যাদার। আর পরিদর্শক থেকে তদূর্ধ্ব পর্যায়ের কর্মকর্তা রয়েছেন ৩২৭ জন। সর্বশেষ গত শুক্রবার রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁও মোড়ে ছিনতাই করতে গিয়ে পুলিশের দুই সদস্য ধরা পড়লে তাদের তত্ক্ষণাৎ বরখাস্ত ও গ্রেফতার করা হয়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) এ কে এম শহীদুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কোনো অপরাধের দায়ভার একান্তই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির। পুলিশ বিভাগ কোনো অপরাধীকে প্রশ্রয় দেয় না। এ ক্ষেত্রে আমরা সব সময়ই ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করি।’

পুলিশের অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়া দেশের জন্য অশুভ সংকেত হিসেবে দেখছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আইনের রক্ষক যখন আইন ভঙ্গ করেন তখন সাধারণ মানুষের আশ্রয়ের কোনো জায়গা থাকে না। প্রয়োজনীয় পুলিশি সেবা নিশ্চিত করতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য পুলিশের অপরাধপ্রবণতা কমাতে কঠোর আইন প্রণয়ন ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। তাদের মতে, অপরাধে জড়িত পুলিশ সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হয় না বলেই অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বাড়ছে। এসব পুলিশ সদস্যের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য আইন যুগোপযোগী করা জরুরি। পুলিশের অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি হাদিস উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কতিপয় পুলিশ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এমন ঘটনা আগেও ছিল। টাকা দিয়ে পুলিশ বিভাগে আসছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। যদি এমনই ঘটে, তাহলে তো সেবার কথা ভুলে পুলিশের টার্গেট থাকবে টাকা কামানো। আর এ টাকা কামাতে গিয়েই পুলিশ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে; যা অনৈতিক।’ তিনি বলেন, ‘পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভালো কাজে পুরস্কার ও মন্দ কাজে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এটা করতে পারলেই পুলিশের অপরাধপ্রবণতা কমে আসবে। পুলিশবাহিনীকে ভুলে গেলে চলবে না, সেবাই তাদের ধর্ম, টাকা অর্জন নয়।’

পুলিশ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেছেন, পুলিশের কোনো সদস্যের অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। যখন কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তখন তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে পুলিশের বিরুদ্ধে যতগুলো লিখিত অভিযোগ জমা পড়ে তার বেশির ভাগের প্রয়োজনীয় প্রমাণ দেখাতে পারেন না অভিযোগকারীরা। পুলিশের হয়রানির শিকার হবেন ভেবে অনেকে অভিযোগও করেন না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ঘটনা সত্য হলেও পার পেয়ে যান অভিযুক্তরা। জানা যায়, ১৮ নভেম্বর ভোরে রাজধানীর সোনারগাঁও ট্রাফিক সিগন্যালের সামনে আবদুল বাছির মনা নামে এক ডিম ব্যবসায়ীর পথরোধ করেন মোটরসাইকেলে আসা পুলিশের দুই কনস্টেবল। তারা মনাকে বলেন, ‘তোর কাছে গাঁজা আছে, তুই গাঁজা সেবন করিস।’ এরপর তারা মনার দেহ তল্লাশি করে, ভয়ভীতি ও হুমকি দিয়ে সঙ্গে থাকা ৪৪ হাজার টাকা নিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। এ সময় লতিফুজ্জামান নামে এক কনস্টেবলকে মনা ধরে ফেললেও অন্য কনস্টেবল পালিয়ে যান। পুলিশ বলছে, মনা বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় দ্রুত বিচার আইনে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় লতিফুজ্জামানকে গ্রেফতার দেখানো হয়। ওইদিনই পালিয়ে থাকা অন্য কনস্টেবল রাজিকুল খন্দকারকে গ্রেফতার করা হয়। তারা দুজনই ডিএমপির ট্রাফিক উত্তর বিভাগের গুলশান জোনে কর্মরত ছিলেন। ঘটনার পরই তাদের বরখাস্ত করা হয়।

১৩ নভেম্বর পুলিশ হেফাজত থেকে ধর্ষণ মামলার আসামি রুবেলকে পালাতে সহায়তা করেন বাড্ডা থানার এসআই এমরানুল হাসান ও কনস্টেবল দীপকচন্দ্র পোদ্দার। এ ঘটনায় তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি আদালত থেকে রিমান্ডের দুই আসামিকে লোকাল বাসে থানায় নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানার এএসআই মশিউর রহমান, কনস্টেবল মোতালেব ও আবদুল লতিফকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ৯ জানুয়ারি মোহাম্মদপুরে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীকে নির্যাতনের ঘটনায় এসআই মাসুদ শিকদারকে প্রত্যাহার করা হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর শাহআলীতে বাবুল মাতুব্বরকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় শাহআলী থানার তৎকালীন এসআই মমিনুর রহমান খান, নিয়াজ উদ্দিন মোল্লা, এএসআই দেবেন্দ্রনাথ ও কনস্টেবল জসিম উদ্দিনকে সাময়িক বরখাস্ত এবং ওসি শাহীন মণ্ডলকে প্রত্যাহার করা হয়। বিভাগীয় তদন্তে ওসি এ কে এম শাহীন মণ্ডল ও কনস্টেবল জসিম উদ্দিনকে অব্যাহতি দিলেও অন্য তিনজনকে গুরুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু পুলিশের এ পাঁচ সদস্যই পুনরায় চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। চলতি বছরে যাত্রাবাড়ী থানার ওসি থাকা অবস্থায় অবনি শংকর করের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করেন এক ভুক্তভোগী নারী। এ ঘটনার পর ওসিকে ডিবিতে বদলি করা হয়। ওই মামলা খারিজ করে দেওয়া হলেও বিভাগীয় মামলা থাকা অবস্থায় তাকে রংপুরের একটি থানায় ওসি হিসেবে বদলি করা হয়। একইভাবে উত্তরা পশ্চিম থানার ওসির দায়িত্ব পালনকালে রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে বাসার ছাদ থেকে ফেলে এক সাংবাদিককে হত্যার অভিযোগ ওঠে। পরে তাকেও বদলি করে ঢাকার বাইরের একটি থানার ওসির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ৬ অক্টোবর চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকায় অস্ত্র বিক্রির সময় গোয়েন্দা পুলিশের এসআই উজ্জ্বলকান্তি দাস ও এএসআই আনিসুর রহমানকে আটক করে র‌্যাব। পরে দুজনকেই বরখাস্ত করা হয়। ২৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার ওসি বেলাল জাহাঙ্গীরসহ দুই এসআইর বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে সজল আচার্য্য নামে এক ব্যবসায়ী আদালতে মামলা করেন। ১৮ জানুয়ারি সিএমপির পাহাড়তলী থানার ওসি রণজিৎ বড়ুয়ার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ তুলে মামলা করেন এক নারী। সিএমপি সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সাত বছরে সিএমপিতে ৩ হাজার ৮৩৬ সদস্যকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর