বুধবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন

ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশ

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শামীম-আইভীর বৈঠক

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশ

শামীম ওসমান - ডা আইভী

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচন সামনে রেখে স্থানীয় এমপি শামীম ওসমান, দলীয় মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীসহ নারায়ণগঞ্জের নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকে সব ভেদাভেদ ভুলে দলীয় প্রার্থীকে জয়ী করতে নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশ দেন তিনি। সেই সঙ্গে শামীম ওসমান ও আইভীকেও ভাইবোনের মতো ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। বৈঠক সূত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। গত রাত সোয়া ৮টার দিকে প্রধানমন্ত্রী সাক্ষাৎ করতে আসা নারায়ণগঞ্জের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. আইভীর বিজয় নিশ্চিত করতে কাজ করার নির্দেশ দেন বলে বৈঠক সূত্র জানায়।

এর আগে সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে গণভবনে প্রবেশ করেন ডা. আইভী। এর কিছুক্ষণ পর প্রবেশ করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমান এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও জেলা পরিষদ প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল হাইসহ জেলা ও মহানগরের নেতারা। এ সময় মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি আনোয়ার হোসেন, বন্দর থানা সভাপতি আবদুর রশিদ, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা সভাপতি মজিবর রহমান ও যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রায় ২৫ জন নেতা উপস্থিত ছিলেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, ডা. দীপু মনি, আবদুর রহমান, জাহাঙ্গীর কবির নানক, ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল প্রমুখ। বৈঠকে নারায়ণগঞ্জের নেতাদের মধ্যে উচ্চবাচ্যও হয়েছে বলে জানা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বৈঠকে শামীম ওসমান ও আনোয়ার হোসেন আইভীর নামে অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে আইভী আওয়ামী লীগের জন্য কাজ করে না। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কাজ করে। জয় বাংলার বিরুদ্ধে কথা বলেছে, আপনার বিরুদ্ধেও (শেখ হাসিনা) কথা বলেছে। সে একজন বিশেষ ব্যক্তির সঙ্গে (ত্বকির বাবা রফিউর রাব্বী) চলাফেরা করে। সব সময় সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে। আমাদের কাছে প্রমাণ আছে।’ এ সময় শামীম ওসমান প্রধানমন্ত্রীকে একটি পত্রিকা দেখাতে চান। জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে তো অনেকেই কথা বলে, আমাকে মাইনাস করার ষড়যন্ত্রও হয়েছে। তাদের ক্ষমা করে দিয়ে সঙ্গে নিয়েই রাজনীতি করছি। আমি যাকে মনোনয়ন দিয়েছি, তার পক্ষে সবাইকে কাজ করতে হবে। দল করতে হলে দলের সিদ্ধান্ত মানতে হবে।’ সভায় আইভী তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ খণ্ডন করে বলেন, ‘এ সবই মিথ্যা। আমি ত্বকি হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলেছি, এটা ঠিক আছে। কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে কথা বলার প্রশ্নই আসে না। আপনার বিরুদ্ধে একটি কথা বলেছি, কেউ প্রমাণ দিতে পারলে রাজনীতি ছেড়ে দেব।’ তখন প্রধানমন্ত্রী তাদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘তোমরা বিবাদ করো না। এখন বিবাদ করার সময় নয়। ভাইবোনের মতো মিল হয়ে এলাকায় যাও। কাজ কর। নৌকার জয় আনতে হবে।’ মহানগর সভাপতি আনোয়ার হোসেন আক্ষেপের সুরে বলেন, ‘নেত্রী! এত বছর রাজনীতি করলাম কিছুই পেলাম না।’ এ সময় প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তখন উভয়েই নেত্রীকে বলেন, ‘নেত্রী! আমাদের মাফ করে দেন। আপনার পা-টা এগিয়ে দেন, সালাম করি।’ তখন প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পাও দেব না, মাথাও দেব না। আগে দলীয় প্রার্থীকে পাস করিয়ে আনো, তারপর সালাম করার সুযোগ দেব।’

বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গণভবনের সামনে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের জানান, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সবাই অঙ্গীকার করেছেন, ঐক্যবদ্ধভাবে দল মনোনীত প্রার্থীকে বিজয়ী করতে নির্বাচনে কাজ করবেন। দল করলে দলের নিয়মশৃঙ্খলা সবাইকে মেনে চলতে হবে। বিএনপি নির্বাচনে আসায় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চ্যালেঞ্জ জেনেই আমরা নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছি। সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করব। সেটাই বৈঠকে আলোচনা হয়েছে এবং সবাই একমত হয়েছেন। এখানে দ্বিমতের কোনো সুযোগ নেই।’ আইভী-শামীম সম্পর্ক নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তাদের সম্পর্ক ভালো ছিল না। আওয়ামী লীগ একটি বিশাল পরিবার। ভাইয়ে ভাইয়েও ঝগড়া হয়। এখানে মৌলিক বিষয় নির্বাচন, ভেদাভেদের সুযোগ নেই। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের দল ঐক্যবদ্ধ আছে। আওয়ামী লীগের ঐক্য অটুট আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কারণ আমরা একটি আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করি। একটি চেতনা নিয়ে রাজনীতি করি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তাই আমরা যাকে মনোনয়ন দিয়েছি, তার পক্ষে নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগের সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন নির্বাচনে নৌকাকে বিজয়ী করতে।’

শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ড আইভীকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেয়। নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মহানগর সভাপতি আনোয়ার হোসেন, বন্দর থানা সভাপতি আবদুর রশিদ, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা সভাপতি মজিবর রহমান এ তিনজনের নাম প্রস্তাব করে কেন্দ্রে পাঠানো হলেও মনোনয়ন বোর্ড সার্বিক বিচারে আইভীকেই মেয়র পদে বেছে নেয়। পরে আইভীর পক্ষে নারায়ণগঞ্জের সকল পর্যায়ের নেতাকে ঐক্যবদ্ধ করতে গতকাল গণভবনে এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।

বিএনপির টিকিট পেলেন সাখাওয়াত : নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে (এনসিসি) মেয়র পদে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন আলোচিত সাত খুন মামলায় বাদীপক্ষের আইনজীবী ও দলের জেলা সহসভাপতি সাখাওয়াত হোসেন খান। এনসিসি নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে লড়বেন তিনি। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দলের এই সিদ্ধান্ত জানান। তিনি বলেন, স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। মনোনয়ন পাওয়ার পর সাখাওয়াত হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমি এই নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। নারায়ণগঞ্জের মানুষ পরিবর্তনের পক্ষে। মানুষ ভোট দেওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জে বিএনপিরই ৬০ ভাগ ভোট রয়েছে। সুষ্ঠু ভোট হলে আমি বিপুল ভোটে জয়ী হব। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমি জনগণের হারানো গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনার লড়াই করব। আমি ভেঙে যাব, কিন্তু মচকাব না। অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী ক্ষমতার দাপট দেখাচ্ছেন। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন।

তিনি সরকারি গাড়ি ও  নগরভবন ব্যবহার করছেন। জেলা পরিষদের প্রশাসক আবদুল হাইও পরিষদে বসে শলাপরামর্শ করছেন। তিনি বলেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হবে। মানুষ ভোট দেওয়ার সুষ্ঠু পরিবেশ চায়। নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন নারায়ণগঞ্জের চঞ্চল?্যকর সাত খুনের মামলার বাদী নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পালের পক্ষের আইনজীবী। এ মামলায় লড়ার কারণে তিনি গত দুই বছরে পরিচিতি পেয়েছেন। বিএনপির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাখাওয়াত হোসেন মেয়র প্রার্থী হওয়ার মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জে তৈমূর আলম খন্দকারের রাজনৈতিক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। যুক্তি হিসেবে তারা বলছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের স্থায়ী কমিটির অনুরোধ তিনি উপেক্ষা করেছেন। এতে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করেন তারা। নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী মনিরুজ্জামান মনির গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে কথা বলেই বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া প্রার্থী ঠিক করেছেন। দলের সব নেতা-কর্মীই দল মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন। আগামীকাল বৃহস্পতিবার নেতা-কর্মীদের নিয়ে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হবে। সুষ্ঠু ভোট হলে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন। গত নির্বাচনে মেয়র পদে জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারকে বিএনপি সমর্থন দিলেও ভোটের আগের রাতে তাকে নির্বাচন থেকে সরে যেতে বলা হয়। দলের  ওই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিভিন্ন সময়ে মনোকষ্টের কথা বলেছেন তিনি।  এবারের নির্বাচনেও বিএনপি তাকে প্রার্থী করার আগ্রহ দেখিয়েছিল। গতবারের তিক্ত অভিজ্ঞতা আর বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না—এমন শঙ্কার কথা জানিয়ে দলীয় প্রার্থী হতে অনীহা প্রকাশ করেন তিনি। জানা যায়, গত সোমবার রাতে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের বিএনপি নেতাদের বৈঠকে দলীয় প্রার্থী হওয়ার জন্য ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন তৈমূর আলম খন্দকার। এ সময় বেগম জিয়া চুপ করে ছিলেন। গতকাল সকালে মেয়র প্রার্থী হিসেবে সাখাওয়াত হোসেন খানের নাম ঘোষণা করা হয়। ফলে নারায়ণগঞ্জে তৈমূর বিরোধীরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। গুলশান কার্যালয়ে বিএনপির বৈঠকে তৈমূর আলম খন্দকার ছাড়াও সাধারণ সম্পাদক কাজী মনিরুজ্জামান মনির, সহ-সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন খান, সাবেক এমপি আবুল কালাম, আতাউর রহমান আঙ্গুর, মহানগর সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম, সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামাল, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির সভাপতি মামনুর রশীদসহ ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

সর্বশেষ খবর