বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন

ইসির শেষ পরীক্ষা

গোলাম রাব্বানী

বিদায়ী নির্বাচন কমিশনের শেষ পরীক্ষা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (এনসিসি) নির্বাচন। আগামী ফেব্রুয়ারিতে বিদায়ের আগে এই সিটি নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে পারবে, তা নিয়ে অনেকটাই চিন্তায় রয়েছে নির্বাচন কমিশন। দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি-অনিয়মের অভিযোগের পর এই সিটি নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা ইসির শেষ পরীক্ষা বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। রাজনৈতিক উত্তাপে সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রতিরোধ, বর্জন, গোলযোগ ও দখলের অভিযোগের মধ্যে সমালোচনার মুখেও পড়ে দেশে প্রথমবারের মতো সার্চ কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া এই কমিশন। এ ছাড়া ইতিমধ্যে এনসিসি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেই নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে অভিযোগ তুলেছেন। এমনকি নির্বাচন কমিশনের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেছেন, নির্বাচন কমিশন আসলে যে চশমা পরেছে, তারা শুধু অন্য গণতান্ত্রিক শক্তি যে রয়েছে তাদেরই দেখে, সরকারি দলকে দেখতে পায় না। তিনি নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের দাবিও তুলেছেন। তবে নির্বাচন কমিশন সেনা মোতায়েনের দাবি নাকচ করে বলেছে, সেনা মোতায়েনের পরিস্থিতি হয়নি। দলভিত্তিক এ সিটি নির্বাচনে ইতিমধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাসদসহ কয়েকটি দল প্রার্থী মনোনয়ন সংগ্রহ করেছে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী হতে আবেদন সংগ্রহ ও জমা দেওয়া যাবে। ২৬ ও ২৭ নভেম্বর বাছাই শেষে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রার্থিতা প্রত?্যাহার করা যাবে। ২২ ডিসেম্বর ভোট হবে এই সিটিতে।

একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ‘এই সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। কেননা এই নির্বাচন ভালো করার সঙ্গে আমাদের সম্মান জড়িয়ে আছে। তাই বিদায়ের আগে এ নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখছি।’

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তাদের সতর্ক করেছে নির্বাচন কমিশন। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের বদলে সার্কিট হাউসে বর্ধিত সভা করা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনাও হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিষয়ে আপাতত ভাবছে না নির্বাচন কমিশন। স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে পরিস্থিতি ভালো রয়েছে বলে জানান ইসি সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা দিয়েই সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। এমন দাবির বিষয়ে ইসি সচিব বলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটিসহ সারা দেশে জেলা পরিষদ নির্বাচন রয়েছে। নির্বাচনী পরিবেশ বেশ ভালো। সেনাবাহিনী দেওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। এ পরিস্থিতিতে নারায়ণগঞ্জে সেনা মোতায়েনের আপাতত কোনো ভাবনা নেই বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সিটি করপোরেশন হিসেবে নারায়ণগঞ্জ প্রতিষ্ঠার পর এটি দ্বিতীয় ভোট। তবে দলভিত্তিক প্রথমবারের মতো এ সিটি করপোরেশনে ভোট হচ্ছে। ২০১১ সালের ৫ মে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা, কদম রসুল পৌরসভা ও সিদ্ধিরগঞ্জ পৌরসভাকে বিলুপ্ত করে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন গঠনের গেজেট প্রকাশ করে সরকার। ওই বছর ৩০ অক্টোবরের এনসিসি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থীকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন শহর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সেলিনা হায়াৎ আইভী। তিনিই দেশের প্রথম নারী মেয়র। কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন ইসির মেয়াদে শেষ নির্বাচন আয়োজনের এটিও একটি। যদিও জেলা পরিষদ নির্বাচন রয়েছে। তবে তা জনগণের ভোটের নির্বাচন নয়।

পাঁচ বছর সেনা, ইভিএম ও সংলাপের এপিঠ-ওপিঠ : নারায়ণগঞ্জের প্রথম সিটি নির্বাচনটি নানাভাবে আলোচিত হয়। উত্তাপ ছড়ানো এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থিত প্রার্থী ও দলের দায়িত্বে থাকা নারী প্রার্থী এবং বিএনপির প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে এ নির্বাচনে সেনা মোতায়েনেরও সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন কমিশন। শেষ পর্যন্ত সেনা মোতায়েন না হওয়ায় তখনকার সিইসি এ টি এম শামসুল হুদা বলেছিলেন, এ সরকারের সঙ্গে কমিশনের ‘বোঝাপড়া’ হবে।

৫৮টি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার হয়। আধুনিক প্রযুক্তির এই যাত্রায় ব্যাপক সাড়া পড়েছিল। মুক্তমঞ্চ থেকে প্রার্থীদের নিয়ে করা হয় নির্বাচনী বিতর্ক। ইসি কর্মকর্তারা জানান, পাঁচ বছর আগের সেনা-ইভিএম-সংলাপের এ চিত্র এবার দেখার কোনো সম্ভাবনা নেই। স্থানীয় নির্বাচনে বর্তমান কমিশন সেনা মোতায়েন করছে না। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের ব্যবহারও থমকে রয়েছে। নারায়ণগঞ্জে তা ব্যবহার হচ্ছেই না। ২০১৩ সালের চার সিটি ভোটের পর নির্বাচনী সংলাপও করেনি তারা। সর্বশেষ ঢাকা ও চট্টগ্রামের ভোটেও নির্বাচনী বিতর্ক করেনি।

মেয়র পদে নয়জন মনোনয়ন নিলেন : তফসিল ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন মেয়র পদে মোট নয়জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৮৮ জন এবং সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৪০ জন। এর মধ্যে মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন একজন। এ ছাড়া কাউন্সিলর পদে ৫৩ জন এবং সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ১১ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। আজ মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমার শেষ দিন।

সেনা মোতায়েন নিয়ে ভাবছে না ইসি : বিএনপি সেনা মোতায়েন চাইলেও পরিস্থিতি ভালো দেখছেন ইসি সচিব। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিষয়ে আপাতত ভাবছে না নির্বাচন কমিশন। স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনে পরিস্থিতি ভালো রয়েছে বলে জানান ইসি সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। তিনি বলেছেন, পরিস্থিতি এমন নেই যে সেনা মোতায়েন করতে হবে। ইতিমধ্যে দুবার বিভিন্ন কাজে নারায়ণগঞ্জ গেছেন উল্লেখ করে সচিব জানান, নির্বাচনী পরিবেশ-পরিস্থিতি ভালো রয়েছে সেখানে। পরিস্থিতি অবনতিরও কোনো শঙ্কা নেই। সেনা মোতায়েন প্রসঙ্গ নিয়ে তফসিল ঘোষণার পরই ১৪ নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন করা হয়ে থাকে। সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ নির্বাচন সামনে রেখে পরিস্থিতি সুষ্ঠু ও সুন্দর রাখতে যখন যেখানে যে ব্যবস্থা দরকার সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে নজরদারি বাড়ানো হবে এবং টাইম টু টাইম অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেব।’ সাধারণত প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় পার হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বৈঠক করে ইসি। সে ক্ষেত্রে ডিসেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধে এ বৈঠক হতে পারে বলে জানান ইসির এই কর্মকর্তা। ভোটের আগে-পরে চার দিনের জন্য নিরাপত্তা সদস্য নিয়োজিত রাখা হতে পারে। ২০১১ সালেও বিএনপি নারায়ণগঞ্জে সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছিল। র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবির সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত এ নির্বাচনে তাদের মোতায়েন করা হয়নি। অনেকের দাবির মুখেও স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করেনি বর্তমান ইসি।

সর্বশেষ খবর