বৃহস্পতিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

আমিই কি স্বাভাবিক?

সমরেশ মজুমদার

আমিই কি স্বাভাবিক?

মাঝে মাঝে খবরের কাগজে কিছু মানুষের কথা ছাপা হয়। এরা কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন, নামকরা খেলোয়াড় বা অভিনেতাও নন। এদের কেউ ট্যাক্সি চালান, কেউ রিকশা অথবা মোটবাহক। কেরানিদের কেউ কেউ খবর হয়ে যান। সেই কবে পড়েছিলাম, অস্বাভাবিক কিছু ঘটনা ঘটলে যা খবরের কাগজে জায়গা পায়। কুকুর মানুষকে কামড়ালে সেটা খবর হয় না, তার ফলে মানুষটির মৃত্যু হয়। কিন্তু মানুষ কুকুরকে কামড়ালে সেটা খবর হয়ে যায়। অতএব, ওই সব সাধারণ মানুষের কথা তখনই কাগজে ছাপা হয় যখন তারা অস্বাভাবিক কোনো কাজ করেন। এই অস্বাভাবিক কাজগুলো কী? ধরা যাক একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে চলে গেলেন। তিনি চলে যাওয়ার পর আপনার খেয়াল হলো ব্যাংক থেকে তোলা ২৫ হাজার টাকার ব্যাগটা আপনি ট্যাক্সিতেই রেখে নেমে এসেছেন। আপনি ট্যাক্সির নম্বর দেখে রাখেননি। ক’জনই বা রাখেন। আপনি থানায় ছুটলেন। কিন্তু নম্বর না বলতে পারায় পুলিশ আপনাকে সাহায্য করতে পারবে না। খুব জরুরি দরকারে টাকাটা তুলেছিলেন আপনি। ওই রকম দিশেহারা অবস্থায় আপনি দেখলেন থানার সামনে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার নেমে আসছেন আপনার টাকার ব্যাগটা হাতে নিয়ে। থানায় ঢুকে অফিসারকে তিনি বললেন, ‘এক ভদ্রলোক আমার ট্যাক্সিতে এই ব্যাগ ফেলে নেমে গিয়েছিলেন। দেখতে পেয়ে তখন তার বাড়িতে ফেরত দিতে গেলাম তখন শুনলাম তিনি থানায় এসেছেন। স্যার, ব্যাগটা ওকে দিয়ে দেবেন। এর মধ্যে ২৫ হাজার টাকা আছে।’ টাকা ফেরত পেয়ে আপনি আপ্লুত হয়ে এক-দুই হাজার দিতে চাইলেন ট্যাক্সি ড্রাইভারকে। তিনি সেটা নিলেন না। পরদিন কাগজে ট্যাক্সি ড্রাইভারের ছবি বের হলো। ‘কেন টাকা ফেরত দিলেন’ প্রশ্নের জবাবে ভদ্রলোক বললেন, ‘নিজে যেটুকু রোজগার করি তাতেই সংসার চালিয়ে স্বস্তিতে থাকি। যে টাকা আমার নয়, তা নেব কেন?’ এরকম খবর আমরা প্রায়ই পড়ি এবং বলি ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। তাই খবর হয়ে কাগজে বের হয়। অর্থাৎ কারও টাকা ফেরত দেওয়া অস্বাভাবিক কাজ, আর আত্মসাৎ করলে স্বাভাবিক হতো? এ ব্যাপারটা প্রমাণ করে আমরা কোথায় পৌঁছে গেছি। ন্যায়নীতি, মানবিকতা বোধগুলোর ব্যবহার এখন অস্বাভাবিক পর্যায়ে চলে গেছে। আমি আপনাকে ঠকাবো, আপনি মিথ্যে বলে কাজ হাসিল করবেন, এটাই এখন অনেকটা স্বাভাবিক। দুই ভাইয়ের মধ্যে জমিজমা নিয়ে বিরোধ লাগল। দুজনেই আলাদা আলাদা পুলিশের কাছে গিয়ে নালিশ জানাল, পুলিশ দুজনের কাছ থেকেই খরচ বাবদ টাকা নিল। নিয়ে বোবা হয়ে রইল। এটাই স্বাভাবিক। যে দুই ভাই একই থালায় খেয়ে বড় হয়েছে তারা পরস্পরকে টাইট করতে টাকা খরচ করছে, এটাও এখন অনেকটা স্বাভাবিক। অর্থাৎ এতকাল বইতে যে কথাগুলো আমাদের পড়তে হয়েছে তা জীবনে বাতিল হয়ে যাচ্ছে। একান্নবর্তী পরিবারের দেড়খানা ঘরে ভালো রোজগার করা ছেলের পক্ষে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকা সম্ভব নয়। এটা সত্যি। তাই সবাইকে জানিয়ে আলাদা ফ্ল্যাটে সে চলে যেতেই পারে। সেখানে তার বিলাসী জীবনযাপন এমন পর্যায়ে চলে যায় যে সে তার নিজস্ব পরিবার নিয়ে থাকতেই স্বচ্ছন্দবোধ করে। খরচ বাড়ে বলে বাবা-মাকে প্রথম প্রথম জানায় টাকার দরকার হলে বলো। কিন্তু ক্রমশ ছেলের ভালো স্কুল, স্ত্রীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, নিজের ক্লাবজীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় সে কথা আর খেয়াল থাকে না। তারপর ছেলে বড় হয়ে গেলে, স্ত্রীর সঙ্গে মতান্তর হলে সে তখন নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের কথাই চিন্তা করে। অর্থাৎ লাটাইয়ের সুতো গুটোতে গুটোতে আত্মসর্বস্ব হয়ে থাকা। এটা এখন এত স্বাভাবিক যে উল্টোটা হলেই চোখে পড়ে। আলাদা হওয়ার পর অনাবশ্যক বাড়তি খরচ কমিয়ে, নিয়মিত বাবা-মাকে সাহায্য করে, মাঝে মাঝে তাদের নিজের বাড়িতে নিয়ে আসা, ছুটির দিনে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে বাবা-মা-ভাইদের সঙ্গে দুপুরটা কাটিয়ে আসা— এখন এত অস্বাভাবিক ব্যাপার যে উদাহরণ খুঁজে পেতে হিমশিম খেতে হবে। মাঝে মাঝে আমার সেসব মহিলার মুখ মনে পড়ে, যারা বিধবা হয়ে বাপের বাড়িতে চলে আসতেন। এসে রান্নাঘর সামলাতেন। সে সব জেঠিমা, কাকিমা যারা বিধবা হয়েও দেওর বা ভাশুরের বাড়িতে থেকে চমৎকার একটা আবহাওয়া তৈরি করতেন, তাদের কেউ আজ পৃথিবীতে নেই। ভাগ্যিস নেই। আজ ওই বয়সের যারা আছেন তাদের অনেকেই অন্যের উপর নির্ভর করে বেঁচে নেই। যারা স্বনির্ভর নন, তারা ভাশুর দেওরের সংসারে নয়, নিজের ছেলের সংসারে বেঁচে আছেন। এদের অনেকেই চলে যাচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমে। বৃদ্ধাশ্রম সম্পর্কে আমাদের ধারণা সেদিন পর্যন্ত ভালো ছিল না। অত্যন্ত অবহেলায়, অনাদরে বৃদ্ধবৃদ্ধাদের সেখানে থাকতে হতো। কিন্তু এখন অবস্থার বদল হয়েছে। কলকাতা এবং তার চারপাশে স্টার ওল্ডএজ হোম এবং ননস্টার ওল্ডএজ হোম চালু হয়েছে। ঝকঝকে খাবারের ঘরে উঁচুমানের খাবার দেওয়া হবে চারবেলা। লাইব্রেরিতে বিভিন্ন রুচির বইয়ের সংখ্যা অনেক। এছাড়া স্পোর্টস রুমে যেমন টেবিল টেনিস খেলার ব্যবস্থা আছে, তেমনি দাবা, ক্যারমের বোর্ডের অভাব নেই। শীতকালে লনে ব্যাডমিন্টন কোর্টে নেমে যেতে পারেন ইচ্ছে হলেই। সুন্দর বাগান আছে বেড়ানোর জন্য। তাছাড়া সপ্তাহে দুদিন ডাক্তার এসে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন নিয়মিত। একটা ছোট কাউন্টার রয়েছে টুকটাক ওষুধের জন্য। সাধারণত যেসব বৃদ্ধবৃদ্ধা একা হয়ে যান, ছেলেমেয়েরা বিদেশে প্রতিষ্ঠিত, দেখাশোনা কথা বলার মানুষের অভাব, তারা বাড়ি বিক্রি করে পঁচিশ-ত্রিশ লাখ টাকা যা পান, তার থেকে ডিপোজিটের টাকা জমা দিয়ে বাকিটা ব্যাংকে রেখে সুদের টাকায় মাসিক খরচ সহজে মেটাতে পারেন। এখানে আসার পর তাদের জীবনযাপনের চেহারা বদলে যায়। ননস্টার ওল্ডএজ হোমে এত স্বাচ্ছন্দ্য থাকে না। কিন্তু নিজস্ব থাকার ঘর, ছোট লাইব্রেরি, ভালো খাবার ছাড়া আবাসিকরা একসঙ্গে আড্ডা মারেন, গানবাজনা করেন। মাঝে মাঝে তাদের বেড়াতেও নিয়ে যাওয়া হয়। এরা স্বাধীনভাবেই থাকেন, একাকিত্বের যন্ত্রণা সইতে হয় না। এ ধরনের হোমে খরচও যথেষ্ট কম। এককালে বাবা-মাকে হোমে পাঠালে মানুষ বাঁকা চোখে তাকাত। বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে কী কষ্টে আছেন তারা, আর ছেলে বউ নিয়ে আনন্দ করছে। তখন যে ভাবনাটা স্বাভাবিক ছিল এখন তা একেবারেই অস্বাভাবিক হয়ে গেছে। তাই মাঝে মাঝে মনে হয়, আমিই কি স্বাভাবিক? এই আমি এত বছর ধরে লিখে যাচ্ছি, লিখে যে অর্থ পাচ্ছি তাতে অনেক সুখ কিনে নিতে পারি, প্রিয়জনদের সুখে না হোক স্বাচ্ছন্দ্যে রাখার চেষ্টা করি, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তো নিজেকে নিয়েই আছি। এমনকি রাতে ঘুমোতে গিয়ে যখন রবীন্দ্রনাথের গান শুনি, তখন সেটা তো নিজের জন্যই। এই যে নিজের জন্য বাঁচা, যা আমার মতো লাখ লাখ লোক করে চলেছে, সেটা কি স্বাভাবিক? কেউ কেউ তো অস্বাভাবিক কাজও করে থাকে। ডাকাতি করে, প্রতারণা করে এবং শেষে জেলে যায়। সেই অস্বাভাবিক কাজগুলো করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর