শিরোনাম
শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

অপরাধে বিমানের পাইলটরা

দেশ-বিদেশের কারাগারে আটক অনেকে, জড়িত সোনা চোরাচালান নারী কেলেঙ্কারি চুরি প্রতারণা জমির দালালিতে

মির্জা মেহেদী তমাল

অপরাধে বিমানের পাইলটরা

সোনা চোরাচালান থেকে জমির দালালি, মোবাইল ফোন সেট চুরি থেকে বিমান লিজের কমিশন বাণিজ্য— সব ধরনের অপকর্মে জড়িত বিমান পাইলটরা। দেশ-বিদেশে তাদের নানা অপরাধে বার বার বিতর্কিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী একমাত্র আকাশ পরিবহন সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। জানা গেছে, দুবাইয়ের শপিং মলে মোবাইল ফোন সেট চুরির অপরাধে কারাগারে যেতে হয় প্রায় সাত লাখ টাকা বেতনভুক বিমানের এক পাইলটকে। ভিডিও ফুটেজ দেখে শনাক্ত হওয়া ওই পাইলটকে ধরতে বিমানের আরেক পাইলটকে জিম্মি করে রেখেছিল দুবাই পুলিশ। সোনা চোরাচালানে অভিযুক্ত আরেক পাইলট দেশের কারাগারে বন্দী দুই বছর ধরে। নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ পাইলটদের বিরুদ্ধে পুরনো হলেও হালে এক নারী নিয়ে দুই পাইলটের মারামারি থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছে। পাসপোর্ট ছাড়া যুক্তরাজ্যে প্রবেশকালে সে দেশ থেকে ফেরত পাঠানো হয় বিমানের অন্য এক পাইলটকে। জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে বিদেশি এয়ারলাইনসে মাসের পর মাস চাকরি করার মতো নজিরবিহীন ঘটনাও ঘটিয়েছেন বিমানের দুই পাইলট। অঢেল সম্পদের মালিক বনে যাওয়া বেশ কয়েকজন পাইলটের বিরুদ্ধে তদন্তও করে দুদক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমানের অন্তত দুই ডজন পাইলটের বিরুদ্ধে এমন নানা অভিযোগ রয়েছে। তারা দেশ-বিদেশে একের পর এক অপরাধে জড়ালেও পাইলটদের সংগঠন বাপার চাপে কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। সাময়িক গ্রাউন্ডেড থাকার পর ফের কাজে যোগ দেন অভিযুক্ত পাইলটরা। বাপার সভাপতি নিজেও অভিযুক্ত জমির দালালিতে। এ ছাড়া দেশি পাইলট বসিয়ে রেখে বিদেশি পাইলট নিয়োগ করে কমিশন বাণিজ্যও করছে বাপা। পাইলটদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা উঠলেই তারা ধর্মঘটের হুমকি দেন। ইতিপূর্বে তাদের ধর্মঘটে অচল হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের আকাশপথ। পাইলটদের এই অপকর্মে বিমান প্রশাসন শাখার একজন কর্মকর্তা বেশ ক্ষুব্ধ কণ্ঠেই বললেন, নিতান্তই অভাব-অনটনে পড়ে দু-চার হাজার টাকার জিনিস চুরি করলে একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু একজন ক্যাপ্টেন বা পাইলট যিনি প্রায় সাত লাখ টাকা বেতন নিচ্ছেন, তিনি যদি এমন চুরির দায়ে বিদেশে গ্রেফতার হন, তা কখনো মেনে নেওয়া যায় না। অথচ এমন জঘন্য অপরাধ আদালতের মাধ্যমে বিদেশের মাটিতে প্রমাণিত হওয়ার পরও বিমান কর্তৃপক্ষ শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। উল্টো ওই পাইলটকে বিমান নিজ খরচে দুবাইয়ের ফাইভ স্টার হোটেলে বেশ কদিন লালন-পালন করেছে। এভাবেই বিমান যুগের পর যুগ অপরাধীদের শাস্তির পরিবর্তে পুরস্কৃত করেছে। বিমান পর্ষদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ক্যাপ্টেন মোসাদ্দেক আহম্মেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কোনো পাইলটের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে বিমান কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেয়। কেউ চোরাচালানে জড়িত থাকলে তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তদন্ত করে। পাশাপাশি বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয় বিমান। ইতিমধ্যে এমন বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

যত অপকর্ম : সোনা চোরাচালান মামলায় ক্যাপ্টেন আবু শহীদ কারাবন্দী দুই বছর ধরে। ২০১৪ সালে তাকেসহ বিমানের চার কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। রিমান্ডে জেরার মুখে তাদের কাছ থেকে বেরিয়ে আসে সোনা চোরাচালানের আদ্যোপান্ত। পুলিশ জানায়, রাসেল নামে এক কেবিন ক্রু সোনা চোরাচালানের একটি ঘটনায় গ্রেফতার হন। তার কাছ থেকেই মূলত বিমানের পাইলট আবু শহীদসহ চারজনের নাম বেরিয়ে আসে। আবু শহীদ গ্রেফতারের পর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা চাকরি ছেড়ে পালিয়ে যান। এ ছাড়া বেশ কয়েকজন ছুটিতে গিয়ে আর কাজে ফেরেননি। সূত্র জানায়, গত আগস্টে দুবাইয়ের ঐতিহ্যবাহী একটি শপিং মলে মোবাইল ফোন সেট চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন নাদিম হাসান নামে এক পাইলট। ‘ক্যারিফোর’ নামক ওই শপিং মলে তিনি ফোন সেট চুরি করেন। এ ঘটনায় বেশ কিছুদিন দুবাই জেলে থাকার পর এখন তার বিচার চলছে সেখানকার আদালতে। ক্যাপ্টেন এন হাসান ওরফে নাদিম হাসান এয়ারবাস ৩১০-এর ফার্স্ট অফিসার। দুবাই পুলিশ ১৬ আগস্ট তাকে গ্রেফতার করে। এ ঘটনায় বিমানজুড়ে তোলপাড় চলে। বিমানের একজন কর্মকর্তা জানান, পাইলট এন হাসান দীর্ঘদিন ধরে ক্যারিফোর থেকে আইফোন, আইপ্যাড, পারফিউমসহ মূল্যবান পণ্যসামগ্রী চুরি করে আসছিলেন। কিন্তু কখনো হাতেনাতে ধরা যায়নি তাকে। সিসিটিভি ফুটেজের মাধ্যমে পুলিশ কো-পাইলটকে শনাক্ত করে দীর্ঘদিন ধরে খুঁজছিল। তবে প্রতিবারই চুরি করে কৌশলে শপিং মল থেকে সটকে পড়তেন। কখনো একা, কখনো বিমানের অন্য পাইলট ও কেবিন ক্রুদের সঙ্গে নিয়ে তিনি ওই শপিং মলে যেতেন। ক্যাপ্টেন হাসান শপিং মল থেকে মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে প্রথমে বাথরুমে যেতেন। এরপর গোপনে ওইসব পণ্য থেকে অ্যালার্ম ট্যাগ খুলে ফেলতেন। তারপর ব্যাগে ভরে সটকে পড়তেন। এর আগে সাত দফা তিনি এভাবে চুরি করে সটকে পড়েন বলে দুবাই পুলিশ জানিয়েছে বিমান কর্তৃপক্ষকে। দুবাই পুলিশ এন হাসানকে ধরতে না পেরে তার সঙ্গে আসা বিমানের অন্য পাইলট ও কেবিন ক্রুদেরও খুঁজতে থাকে। এয়ারবাসের অন্য পাইলট মোহাম্মদ আলী ওই শপিং মলে কেনাকাটা করতে যান। তিনি সেখানে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে মলের সিকিউরিটি লাইট জ্বলে ওঠে, বেজে ওঠে অ্যালার্ম। এরপর পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ তল্লাশি করে জানতে পারে এর আগে কো-পাইলট এন হাসানের সঙ্গে পাইলট আলী কয়েকবার ওই শপিং মলে এসেছিলেন। তবে ক্যাপ্টেন আলী কোনো ধরনের চুরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে। এরপর পুলিশ ক্যাপ্টেন আলীকে তাদের হেফাজতে নিয়ে যায়। সিসিটিভিতে পাইলট নাদিম হাসানের ছবি দেখিয়ে তার নাম-পরিচয় জানতে চায়। ক্যাপ্টেন আলী ছবি দেখে নাদিম হাসানকে শনাক্ত করেন। নাদিম হাসান বাংলাদেশ বিমানের একজন কো-পাইলট ও তার সহকর্মী বলে পরিচয় দেন। এরপর পুলিশ বিষয়টি বাংলাদেশ বিমানের দুবাই অফিসকে জানায় ও বাংলাদেশ বিমান অফিসকে অবহিত করে। দুবাই পুলিশ জানায়, কো-পাইলট নাদিম হাসানকে তাদের হাতে সোপর্দ না করা পর্যন্ত ক্যাপ্টেন আলীকে ছাড়বে না তারা। তত্ক্ষণাৎ বিমানের দুবাই ও ঢাকা অফিস কো-পাইলট এন হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারে তিনি আবুধাবিতে আছেন। এরপর বিষয়টি গোপন রেখে ঢাকা অফিস থেকে এন হাসানকে জরুরি ভিত্তিতে দুবাই গিয়ে পাইলট আলীর কাছে রিপোর্ট করার নির্দেশ দেওয়া হয়। খবর পেয়ে এন হাসান ২ ঘণ্টায় আবুধাবি থেকে দুবাই যান। তিনি পাইলট আলীকে ফোন দিলে তাকে ক্যারিফোর শপিং মলে যেতে বলেন। তখনো এন হাসান বিষয়টি বুঝতে পারেননি। এন হাসান ওই শপিং মলে আসার সঙ্গে সঙ্গে দুবাই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায়। পাইলট আলীকে পুলিশ ছেড়ে দেয়। তবে তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিছুদিন তিনি দুবাইয়ের হায়াত হোটেলে অনেকটা অবরুদ্ধ থাকার পর জরিমানা দিয়ে দেশে ফেরেন। এমন চুরি-চামারির পরও পাইলটদের সংগঠন বাংলাদেশ পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন মাহবুব তাকে বাঁচানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। সূত্র জানায়, সোনিয়া নামে এক বিমানবালাকে নিয়ে দুই পাইলটের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। ত্রিমুখী প্রণয়ের ঘটনা শেষতক থানা পর্যন্ত গড়ায়। সূত্র জানায়, কয়েক সপ্তাহ আগের এক রাতে উত্তরার একটি রেস্টুরেন্টে সোনিয়াকে নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন পাইলট মোকাসসিত ও আতিশ। একপর্যায়ে সোনিয়ার ভালোবাসার দাবিদার এ দুই পাইলটের মধ্যে তর্কবিতর্ক ও হাতাহাতি শুরু হয়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে রেস্টুরেন্ট থেকে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ তাদের থানায় নিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত উভয়েই থানায় জিডি করে একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগ করেন। পুলিশ পরে তাদের ছেড়ে দেয়। সূত্র জানায়, বাপার সভাপতি ক্যাপ্টেন মাহবুব জমির দালালি করতে গিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন তারই দুই সহকর্মী ফার্স্ট অফিসার নেওয়াজ ও ইফতেখারের সঙ্গে। গাজীপুরে একটি জমির দালালি নিয়ে এ তিনজনের মধ্যে চরম বিরোধের বিষয়টি বাপায় শালিসের মধ্যে শেষ হয়। সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারিতে বিনা পাসপোর্টে যুক্তরাজ্যে ঢুকতে গেলে সিনিয়র পাইলট ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয় লন্ডন ইমিগ্রেশন পুলিশ। পাইলটের এই অপরাধে বিমানকে ২ হাজার পাউন্ড জরিমানাও গুনতে হয়েছে। পরে আরেক পাইলট পাঠিয়ে ফ্লাইটটি আনা হয়। সূত্র জানায়, আহমেদ ইমরান নামে এক পাইলট ডেপুটি চিফ অব ট্রেনিংয়ের দায়িত্বে থাকার সময় অসংখ্য নারী কেলেঙ্কারির জন্ম দেন। দুই দিনের ফ্লাইটগুলোয় তিনি নিজে যেতেন কুয়েত, দুবাই ও মাস্কাট। সেখানে নতুন নিয়োগ পাওয়া সুন্দরী বিমানবালাদের নিজের কাছে রেখে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে বিমানের সাবেক চেয়ারম্যানের বাসায়ও অনেক দেনদরবার হয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতি ও জাল-জালিয়াতির কারণে কাতার এয়ারওয়েজ থেকে চাকরিচ্যুত বিমানের দুই পাইলট ক্যাপ্টেন মুনিম ও ক্যাপ্টেন মোকাচ্ছিদকে (ফার্স্ট অফিসার) নিয়োগ দেয় বিমান। জানা গেছে, এ দুই পাইলট বিমান থেকে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি)’ না নিয়ে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে এনওসি ও রিলিজ অর্ডার বানিয়ে কাতার এয়ারওয়েজে যোগ দেন। এরপর একজন আমেরিকা, অন্যজন কানাডা যাওয়ার কথা বলে বিমান ম্যানেজমেন্ট থেকে ছুটি নেন। ছুটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় আবারও ছুটির জন্য আবেদন করেন। বিমানের সন্দেহ হলে গোপনে তদন্ত করে দেখা যায় তারা ছুটির নামে কাতার এয়ারওয়েজে চাকরি করছেন। এ অবস্থায় বিমান কাতার এয়ারওয়েজ কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে দুই পাইলটকে বিমানে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ করা হয়। চিঠির উত্তরে কাতার এয়ারওয়েজ দুই পাইলটের দেওয়া সব কাগজপত্র বিমানে পাঠায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায় সব কাগজপত্র জাল ও ভুয়া। বিষয়টি কাতার এয়ারওয়েজকে জানানোর সঙ্গে সঙ্গে তারা ক্যাপ্টেন মুনিম ও মোকাচ্ছিদকে বরখাস্ত করে। এরপর তারা আত্মসমর্পণ করে অনিয়ম-দুর্নীতির কথা স্বীকার করে নিজেদের আবার বিমানে কাজ করার সুযোগ চেয়ে আবেদন করেন। সূত্র জানায়, নজরুল শামীম নামে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এক পাইলট বিমানে চাকরির পাশাপাশি ব্যবসাও করেছেন। তিনি বিমানের ট্রেনিং শাখায় বিনা টেন্ডারে এয়ারকন্ডিশনার ও কম্পিউটার সরবরাহ করে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেন। তৎকালীন পরিচালক প্রশাসন রজোপতি সরকারের যোগসাজশে এ ব্যবসার ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর বর্তমান পর্ষদ দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই নজরুল শামীমের বেতন-ভাতা বন্ধ রাখে। তিনি আর ক্যাপ্টেন ইশরাত মিলে ইজিপ্ট এয়ার থেকে দুটি বোয়িং-৭৭৭ লিজে এনে কমিশন ব্যবসাও করেছেন। এখন এ নিয়ে তাদের মধ্যে চলছে ঠাণ্ডা লড়াই।

সর্বশেষ খবর