শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
বিশেষজ্ঞ মত

উৎসাহিত হবে বাল্যবিবাহ

জিন্নাতুন নূর

মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর রেখে মন্ত্রিসভায় গতকাল ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৬’-এর খসড়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু খসড়ায় বিশেষ ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশে ও মা-বাবার সম্মতিতে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদেরও বিয়ে দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। আর এমনটি করায় এ সিদ্ধান্তের প্রতি তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন নারীনেত্রী ও সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা। বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্তে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের অপব্যবহার হবে এবং অভিভাবকরা মেয়েদের বাল্যবিবাহ দিতে আরও উৎসাহিত হবেন। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দ্বৈত নীতি না রেখে এক নীতি মানা উচিত। এ ছাড়া সরকার বাল্যবিবাহ বন্ধে মৌখিক অঙ্গীকার করলেও ভোটের রাজনীতির জন্যই খসড়া আইনে এমন সুযোগ রেখেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেন। তাদের মতে, সরকার উন্নয়নের কথা বলে মেয়েদের জন্য পরস্পরবিরোধী নীতি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘এর মাধ্যমে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের নানাভাবে অপব্যবহার হবে। অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ের জন্য সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য খুব দুর্ভাগ্যজনক, দুঃখজনক এবং চরম নিন্দনীয়। একই সঙ্গে এর ফলে বাল্যবিবাহের হারও বৃদ্ধি পাবে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাসহ আমরা সবাই বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়েদের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণে সুপারিশ রেখেছিলাম। আমি বুঝতে পারছি না যে, সরকার একদিকে স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের কথা বলছে, যেখানে কেউ পিছিয়ে পড়বে না; কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, এ ধরনের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মেয়েদের পিছিয়ে পড়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ফলে এর মাধ্যমে পরস্পরবিরোধী নীতি গ্রহণ করছে সরকার।’ বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ‘আমি পুরো আইনের খসড়াটি না পড়ে এ সম্পর্কে বিস্তারিত মন্তব্য করতে চাই না। তবে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে খসড়ায় যে সুযোগ রাখার কথা জানতে পেরেছি, তাতে আশঙ্কা করছি যে যদি বিষয়টি পরিবর্তন করা না হয় তবে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৬-এর অপব্যবহার হওয়ার অনেক সুযোগ আছে। আগে মেয়েদের বিয়ের জন্য ১৮ বছর বয়স নির্ধারণ করা হলেও সেটিও মানা হতো না। ১৮ বছরের চেয়ে কম বয়সেও মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার নজির ছিল। কম বয়সী মেয়েদের বয়স বৃদ্ধি করেই বিয়ে দেওয়া হতো।’ তিনি বলেন, ‘এ-সংক্রান্ত আইনের মাধ্যমে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের ১৮ বছরের আগেই বিয়ে দেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। বিশেষ করে এর মাধ্যমে বাল্যবিবাহের পক্ষে থাকা আইনজীবী, পরিবার ও কাজিরা নানা রকম বুদ্ধি বের করবেন। আর যে উদ্দেশ্যে এ আইনটি করা হয়েছে, এর সুফল ভোগের পরিবর্তে বাল্যবিবাহের হার আরও বৃদ্ধি পাবে।’ বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, খসড়ার এই দ্বৈত নীতির কারণে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েরা ভুক্তভোগী হবে। পাশাপাশি হবে আইনটির অপব্যবহার। আর অভিভাবকরাই এর অপব্যবহার করবেন। এ বিষয়ে একটিই আইন হতে পারে, আর তা হলো, ১৮ বছরের নিচে কোনো মেয়েকেই বিয়ে দেওয়া যাবে না। কাউকে ১৮ বছরের কম বয়সে বিয়ে দেওয়া হলে অভিযুক্তদের আইনের আওতায় শাস্তি ভোগ করতে হবে। আর এটি নিশ্চিত করা না গেলে বাল্যবিবাহ কখনো বন্ধ করা যাবে না। দুঃখজনক যে, এ বিষয়ে সরকার দ্বৈত নীতিতে বিশ্বাস করে। কোন কাজটি করলে সরকার ভোট হারাবে আর কোনটি করলে ভোট পাবে, সে বিষয়টি মাথায় রেখেই এ আইনের খসড়া তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ এখানে ভোটের রাজনীতি কাজ করছে। এমনকি এ বিষয়ে সরকার নিজেরাও স্পষ্ট না যে তারা কী চায়। মেয়েদের বিষয়ে সরকারের মধ্যে এক ধরনের অস্বচ্ছতা দেখা যাচ্ছে। এলিনা খান প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘যদি কোনো পাঁচ বছরের মেয়েশিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়, তবে কি সেই শিশুটিকে তার অভিভাবকরা ওই বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেবেন? আমাদের এ-সংক্রান্ত আইনে এক নীতির কথা ভাবতে হবে। কোনো কারণে একটি মেয়ে যদি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, তবে সে ক্ষেত্রে তাকে রক্ষার জন্য রাষ্ট্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে। মোট কথা, এই খসড়ার মাধ্যমে অভিভাবকরা বাল্যবিবাহের প্রতি আরও উৎসাহিত হবেন। যেখানে দেশে বাল্যবিবাহের হার কমছিল, সেখানে সরকারের এমন সিদ্ধান্তের ফলে বাল্যবিবাহ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আশঙ্কা করছি।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর