শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ঢাবি হলগুলোয় ‘বিকল্প প্রশাসন’ ছাত্রলীগের

ফরহাদ উদ্দীন

ঢাবি হলগুলোয় ‘বিকল্প প্রশাসন’ ছাত্রলীগের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নিরঙ্কুশ আধিপত্য চলছে। ছাত্র রাজনীতির আঁতুড়ঘর খ্যাত মধুর ক্যান্টিন থেকে শুরু করে আবাসিক হল পর্যন্ত ক্যাম্পাসের সর্বত্র এ সংগঠনের কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ, যৌন হয়রানি, ফাও খাওয়াসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন সংগঠনটির একশ্রেণির নেতা-কর্মী। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতে, বিরোধী ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নিষ্ক্রিয়তা ও বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর স্থবিরতায় ক্ষমতার রাজনীতিতে ক্যাম্পাসে এখন কেবলই ছাত্রলীগ। ঢাবির রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী মধুর ক্যান্টিনের এক পাশের চেয়ার-টেবিল ছাত্রলীগ, অন্য পাশের বাম ও সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের জন্য বরাদ্দ। সম্প্রতি এ সংস্কৃতির বিলুপ্তি ঘটেছে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও ঢাবি শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক মধুর ক্যান্টিনে এলেই সব চেয়ার দখলে নেন সংগঠনটির কর্মীরা। অন্যান্য টেবিল খালি থাকলেও বাম সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। কেউ কেউ নিরুপায় হয়ে টেবিলের ওপর বসে পড়েন। অনেক সময় ক্যান্টিন জুড়ে ছাত্রলীগের অবস্থানের কারণে অন্য সংগঠনের কার্যক্রম এমনকি সংবাদ সম্মেলনের কাজে বাধার সৃষ্টি হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছয় বছর ধরে ঢাবি ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারছে না ছাত্রদল। ২০১০ সালের ১৮ জানুয়ারি ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ছাত্রলীগের আক্রমণের শিকার হওয়ার পরই সংগঠনটি ক্যাম্পাসছাড়া। পরে হিরণ-মাসুদ ও বর্তমান মেহেদী-বাসার কমিটিও ঢাবি ক্যাম্পাসে যেতে ব্যর্থ হয়। অভ্যন্তরীণ বিভক্তি, দলাদলি ও আদর্শগত দূরত্বের কারণে বাম সংগঠনগুলোও দুর্বল। ফলে ক্যাম্পাস জুড়ে রাজত্ব এখন ছাত্রলীগের। এ ব্যাপারে ছাত্র ইউনিয়ন ঢাবি শাখার সাবেক সভাপতি লিটন নন্দী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘চেয়ার দখলের বিষয়টি আমরা ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দকে অবহিত করেছি। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। এটি রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত।’ ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মাহমুদ উল্লাহ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রশ্রয়ে ছাত্রলীগ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত; যার মাশুল দিতে হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের। এসব অভিযোগ সম্পর্কে ছাত্রলীগ ঢাবি শাখার সভাপতি আবিদ আল হাসান বলেন, ‘আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছি। সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের পক্ষে ১৯ দফা দাবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে জানিয়েছি। তবে ক্যাম্পাসে কেউ ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে অপকর্ম করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ঢাবির ১৮টি আবাসিক হলে ‘বিকল্প প্রশাসন’ হিসেবে কাজ করে ছাত্রলীগ। শিক্ষার্থীদের সিটে ওঠানো বা নামানো, সিট বরাদ্দ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রলীগ নেতারা। আবাসন সংকট পুঁজি করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এক রকম জিম্মি করে রেখেছেন তারা। হল প্রশাসন অনেকটা ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’। জানা যায়, শিক্ষার্থীদের জোর করে ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করতে হলে হলে গণরুম তৈরি করা হয়েছে। সূর্যসেন হলে ১৪, জগন্নাথ হলে ১২, এ এফ রহমান হলে ৫, জহুরুল হক হলে ১০, জিয়াউর রহমান হলে ৮, বঙ্গবন্ধু হলে ৯, জসীমউদ্দীন হলে ১২, মুহসীন হলে ১৫, রোকেয়া হলে ২, কুয়েত-মৈত্রী হলে ৪ ও ফজিলাতুন নেছা মুজিব হলে ৩টি গণরুম আছে। শিক্ষার্থীরা জানান, আবাসিক হলগুলোর গেস্টরুমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ডেকে আদব-কায়তা শেখানোর নামে ছাত্রলীগ নেতারা নির্যাতন করেন। ২ ফেব্রুয়ারি এস এম হলের মার্কেটিং বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হাফিজুর মোল্লা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। পরিবারের অভিযোগ, হাফিজকে গেস্টরুমে নিয়ে দাঁড় করিয়ে নির্যাতন করায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে এক রকম বিনা চিকিৎসায় মারা যান। ২২ নভেম্বর গভীর রাতে বিজয় একাত্তর হলে আসাদুজ্জামান নামে এক শিক্ষার্থীকে গেস্টরুমে নিয়ে হেনস্তার একপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরে তাকে মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, ফজলুল হক হল, জগন্নাথ হল, এস এম হল, মুহসীন হল, জহুরুল হক হলসহ কয়েকটি হল ছাত্রলীগ নেতাদের মাদক ব্যবসার অভয়াশ্রম। সম্প্রতি বিজয় একাত্তর হলের এক ছাত্রলীগ নেতার কক্ষ থেকে আমিনুল ইসলাম নামে এক ইয়াবা ব্যবসায়ীকে আটক করে পুলিশে দেয় হল প্রশাসন। এর আগে ফজলুল হক হল থেকে মদের বোতল, বিয়ারসহ এক নেতাকে আটক করা হয়। মুহসীন হল থেকে দুই দফা ইয়াবার বড় চালানসহ আটক করা হয় ১৫ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ও ক্যান্টিনে বাকির নামে ছাত্রলীগ নেতাদের ফাও খাওয়ার মহোৎসব চলছে।

প্রতিটি হলেই দোকান ও ক্যান্টিনে রয়েছে ছাত্রলীগ নেতাদের হাজার হাজার টাকা বাকি। সম্প্রতি ফাও খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় সূর্যসেন হলের তসলিমের খাবার দোকান বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া ক্যান্টিন ও দোকান থেকে নেতাদের রুমে রুমে খাবার না পাঠালে মারধরের শিকার হতে হয় সাধারণ দোকানদারদের। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, চানখাঁরপুল, পলাশী, ফুলার এলাকায় ছিনতাই-চাঁদাবাজির ঘটনায়ও ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। ঢাবি ও কেন্দ্রীয় কমিটির কিছু নেতার ছিনতাই ও চাঁদাবাজির কয়েকটি সিন্ডিকেট আছে। ক্যাম্পাসে বেড়াতে আসা লোকজনকে মারধর করে চাঁদা আদায় ও মোটরসাইকেল, ল্যাপটপসহ গুরুত্ব্বপূর্ণ জিনিস ছিনতাই করা হয় এসব সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। ঢাবির ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক এ এম আমজাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ক্যাম্পাসে অপরাধ দমনে প্রশাসন সব সময় তৎপর। অপরাধী যেই হোক, তথ্য-প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

সর্বশেষ খবর