বৃহস্পতিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

নেতাদের চাঁদা দিয়ে হলে ওঠে রাবির শিক্ষার্থীরা

জয়শ্রী ভাদুড়ী, রাবি

নেতাদের চাঁদা দিয়ে হলে ওঠে রাবির শিক্ষার্থীরা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ক্যাম্পাসে অন্য ছাত্র সংগঠনগুলোর নড়বড়ে অবস্থার সুযোগে সেখানে একক আধিপত্য কায়েম করেছে ছাত্রলীগ। ফলে হলের সিট বাণিজ্য থেকে শুরু করে টেন্ডার, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, যৌন হয়রানি, ডাইনিং ও ক্যান্টিনে ফাও খাওয়া, অপহরণসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন সংগঠনটির একশ্রেণির নেতা-কর্মী। আর এই অপরাধ কর্মকাণ্ডের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিকার হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। রাবির হল প্রশাসন থেকে সিট বরাদ্দ পাওয়ার পরও সিটে ওঠার জন্য ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দেড় থেকে দুই হাজার টাকা দিতে হয়। একই সঙ্গে শর্ত থাকে মাসে মাসে নির্ধারিত হারে চাঁদা দেওয়ার। কথিত এ প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত না হলে ফি দিয়ে হলে ভর্তি হয়ে শিক্ষার্থীদের থাকতে হচ্ছে মেস বা ভাড়া বাড়িতে। অন্যদিকে ছাত্রী হলে সিট পেতে ছাত্রলীগের নারী নেত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে প্রেমে জড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রেমের সম্পর্কে জড়ালে যখন-তখন নিয়মবহির্ভূতভাবে এক কক্ষবিশিষ্ট সিটও পায় প্রথম কিংবা দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রীরা। ছাত্রদের ১১টি হলে অনুসন্ধানে জানা যায়, দুই শতাধিক শিক্ষার্থীর খোঁজ পাওয়া গেছে, যারা ছাত্রলীগকে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা দিয়ে হলে সিট পেয়েছেন। এর মধ্যে শহীদ হবিবুর রহমান হলে ১৪২ জনের মধ্যে ৬৮ জন, শহীদ শামসুজ্জোহা হলে ৫৯ জনের মধ্যে ২৩ জন, শেরেবাংলা হলে ৪৮ জনের মধ্যে ২৬ জন, সৈয়দ আমীর আলী হলে ৬৩ জনের মধ্যে ৪৭ জন, মাদারবখশ হলে ৭৪ জনের মধ্যে ২১ জন, বঙ্গবন্ধু হলে ৯১ জনের মধ্যে ২৮ জন শিক্ষার্থী চাঁদা দিয়ে হলে উঠেছেন।

প্যাকেজে চাঁদা আদায়ে সক্রিয় হল ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অন্তত ৩০ জন নেতা-কর্মী। তাদের মধ্যে অতি সক্রিয় নেতারা হলেন— বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল শাখার ছাত্রলীগ সভাপতি আরিফুল ইসলাম, শাহ্ মখদুম হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মুশফিক তাহমিদ তন্ময়, কর্মী কায়সার, ওমর ফারুক, সৈয়দ আমির আলী হলের সভাপতি নাজমুল ইসলাম সজল, সাধারণ সম্পাদক সৈকত হুসাইন, ছাত্রলীগ কর্মী তরিকুল ইসলাম বাবু, শেরেবাংলা হলের ছাত্রলীগ কর্মী রেজাউল করিম রাজু, নবাব আবদুল লতিফ হলের যুগ্ম সম্পাদক কামরুজ্জামান, শামসুজ্জোহা হল শাখার সভাপতি জিল্লুর রহমান মাসুম, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক আবদুল্লাহ আল গালিব, শহীদ হবিবুর রহমান হলের সভাপতি বায়োজিদ, মাদারবখশ হলের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা ও শহীদ জিয়াউর রহমান হলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের গণযোগাযোগ বিষয়ক সম্পাদক আজহারুল ইসলাম শাওন। তমব যোগাযোগ করা হলে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন তারা। তাদের অধিকাংশেরই বক্তব্য হচ্ছে, কাউন্সিল সামনে রেখে বিরোধী কোনো পক্ষ তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাবির বিভিন্ন দোকান, ক্যাফেটেরিয়া এবং হলের ক্যান্টিনগুলোতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বাকির নামে ফাও খাওয়ায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন গরিব অসহায় ক্যান্টিন মালিকরা। অনেকে বিনা খরচে জীবন ধারণ করার জন্য ছাত্রলীগের খাতায় নাম লেখায়। তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করেন বলে অভিযোগ করেন তাদের নিজ দলের কর্মীরাই। আবাসিক হলগুলোতে একেকজন নেতা-কর্মীর বাকির পরিমাণ ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা বলে ক্যান্টিন মালিকরা জানিয়েছেন। অনেকেই বিভিন্ন ক্যান্টিনে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত বাকি খেয়ে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। প্রাণের ভয়ে এসব নেতা-কর্মীর নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি ক্যান্টিন ও ডাইনিংয়ের মলিকরা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যত ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে তার সবখানেই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা জড়িত থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এরকম কয়েকটি ঘটনায় ছিনতাইকারী ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীকে হাতেনাতে ধরে পিটুনি দেওয়ার মতো ঘটনাও আছে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক জনি আহমেদ ওরফে সজীবকে ছিনতাইয়ের সময় আটক করে তার মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয় শিক্ষার্থীরা।

মেডিকেল সেন্টারের তিনটি অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যে দুটি ছাত্রদের আর একটি ছাত্রীদের জন্য ব্যবহূত হয়। তবে ছেলেদের জন্য নির্ধারিত অ্যাম্বুলেন্স দুটি রাত সাড়ে ৯টার পর প্রায়ই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ব্যবহার করেন বলে চালকরা অভিযোগ করেন। তারা জানান, যেতে না চাইলে চালকদের হুমকি-ধমকি দেন তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অ্যাম্বুলেন্সের চালকরা বলেন, শের-ই-বাংলা, হবিবুর, মাদারবখশ, বঙ্গবন্ধু হলের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা প্রায়ই ব্যক্তিগত কাজে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে নেন। রাতে লক্ষ্মীপুরে চা খাওয়ার নামে আজেবাজে জিনিস কিনতে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে যান তারা। হবিবুর ও মাদারবখশ হলের ছেলেরা কয়েক মাস আগে ইয়াবা কিনতে গভীর রাতে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে গেলে বোয়ালিয়া মডেল থানা পুলিশ তা আটকে দেয়। পরে দেনদরবার করে ছাড়িয়ে আনা হয়।

আম ও লিচুর মৌসুমে খুব অল্প দরে ইজারা নিয়ে থাকেন ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ নেতারা। তারা আবার বেশি দরে এগুলো ব্যবসায়ীদের কাছে ইজারা দিয়ে লাভ কুড়ান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয় কৃষি প্রকল্পের একজন কর্মকর্তা জানান, শুধু গাছ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুরগুলো খুব অল্প মূল্যে ইজারা দেওয়া হয়েছে রাবি ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের সুপারিশে। যেগুলোর বাজার মূল্য কয়েকগুণ বেশি। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক খালিদ হাসান বিপ্লব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পুকুর বা গাছ— এগুলো ইজারা দিতে আমি কখনো সুপারিশ করিনি। আর হলের সিটে যারা বৈধ শিক্ষার্থী তারাই উঠবে। আর অবৈধ কাজে কারও জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর