বৃহস্পতিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিমানের ছয় কর্মকর্তা বরখাস্ত

প্রধানমন্ত্রীবাহী বিমানে ত্রুটি, ছিল আগুনের ঝুঁকি

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিমান কর্মকর্তাদের চরম দায়িত্বহীনতা ও গাফিলতিতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। আর এজন্য দায়ী প্রকৌশল বিভাগের ছয় কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বিমানের চিফ অব টেকনিক্যাল ক্যাপ্টেন ফজল মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে চার সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন গত রাতে প্রকাশের পর ছয় কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়। প্রতিবেদনে এ ছয় কর্মকর্তার দায়িত্বে অবহেলা ও অদক্ষতার বিষয়টি উঠে এসেছে। এরা হলেন বিমানের ইঞ্জিনিয়ারিং কর্মকর্তা এস এস রোকনুজ্জামান, সামিউল হক, লুত্ফর রহমান, মিলনচন্দ্র বিশ্বাস ও জাকির হোসাইন এবং কারিগরি কর্মকর্তা  সিদ্দিকুর রহমান। এর আগে সন্ধ্যায় বেসামরিক বিমান পরিবহনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন সচিবালয়ের নিজ কার্যালয়ে বিমানের প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করে বলেন, এ ঘটনায় ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের পাঁচ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হচ্ছে। তবে এ সংখ্যা বাড়তে পারে। এ সময় অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের নাম বলেননি তিনি। মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের আধা ঘণ্টা পরই ছয় কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়। রবিবার হাঙ্গেরি সফরে রওনা হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানের একটি বোয়িং-৭৭৭ বিমান যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশখাবাতে জরুরি অবতরণ করে। প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের সেখানে ৪ ঘণ্টা অনির্ধারিত যাত্রাবিরতি করতে হয়। ত্রুটি মেরামতের পর ওই উড়োজাহাজেই তিনি ও তার সফরসঙ্গীরা বুদাপেস্টে পৌঁছান। এ ঘটনা তদন্তে বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ তিনটি তদন্ত কমিটি করে। এর মধ্যে বিমানের তদন্ত প্রতিবেদন গতকাল নির্ধারিত দিনেই জমা দেওয়া হয়। তবে এ প্রতিবেদন বিকাল ৩টায় মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার কথা থাকলেও তা মন্ত্রীর হাতে পৌঁছে সন্ধ্যার পর। দুপুর থেকেই মন্ত্রণালয়ে অপেক্ষায় ছিলেন গণমাধ্যমকর্মীরা। সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের সামনে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বেসামরিক বিমান পরিবহনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। মন্ত্রী বলেন, বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবহেলা ও ম্যানেজমেন্টের অদক্ষতার কারণে এ ত্রুটি হয়েছে। করাচি ক্রস করার পর যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ে। ত্রুটিটি ছিল, বিমানের ইঞ্জিনে অয়েল (লুব্রিক্যান্ট) সিস্টেমের একটি নাট-বোল্ট অর্ধেক খোলা ছিল। ওই ঢিলা অংশ দিয়ে ইঞ্জিন থেকে লুব্রিক্যান্ট বেরিয়ে যায়। এতে ওই ইঞ্জিনে জিরো হয়ে যায় অয়েল; যার কারণে বাধ্য হয়ে ফ্লাইটটির গতিপথ পরিবর্তন করা হয়। তিনি বলেন, কর্মকর্তাদের গাফিলতিতেই প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। এ ঘটনায় বিমানের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের পাঁচ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হচ্ছে।

সেদিনের ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা নাকি সাবোট্যাজ— সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, বিমানের চেয়ারম্যান তাকে জানিয়েছেন, তদন্তে তিনটি ফ্যাক্টর বিবেচনায় আনা হয়েছে— যান্ত্রিক ত্রুটি কিনা, পরিবেশগত ব্যাপার কিনা (বেশি ঠাণ্ডা বা ঝড়) ও হিউম্যান ফ্যাক্টর ইনভল্ব কিনা। হিউম্যান ফেইলুর ফ্যাক্টর প্রধান বলে তারা চিহ্নিত করেছেন। হিউম্যান ফেইলুর ফ্যাক্টরকে চিহ্নিত করার ভিত্তিতে পাঁচজন অথবা এক-দুজন বেশিও হতে পারেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ইতিমধ্যে ম্যানেজমেন্টকে জানিয়েছেন। মন্ত্রী বলেন, ‘আশা করি আজ রাত বা কাল সকালের মধ্যে সে ব্যবস্থা তারা নেবেন।’ তার এ বক্তব্যের ২০ মিনিটের মধ্যেই মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ওই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানো হয়।

তিন দিনের হাঙ্গেরি সফর শেষে গতকাল দেশের পথে যাত্রা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার দেশে ফেরার আগেই বিমানে ত্রুটির জন্য ‘দায়ীদের’ চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিল বিমান কর্তৃপক্ষ, যে ঘোষণা ঘটনার পরদিন দিয়েছিলেন মন্ত্রী মেনন। প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমান উড্ডয়নের আগে একাধিকবার পরীক্ষা করার পরও নাট-বোল্ট ঢিলে হয়ে থাকা সংশ্লিষ্ট কারও অবহেলা নাকি ষড়যন্ত্র, তা খতিয়ে দেখে তদন্ত কমিটি। এ ঘটনার তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, একটি নাট ঢিলা থাকায় ইঞ্জিনের অয়েল পড়ে যায়। অয়েল একেবারে পড়ে গেলে ইঞ্জিন শুকিয়ে যেত। তখন ঘর্ষণের ফলে ইঞ্জিন অতিরিক্ত গরমে আগুন ধরে যেতে পারত। খতিয়ে দেখা হয়েছে, এটি অবহেলা নাকি ইচ্ছাকৃত করা হয়েছে। তদন্তে অবহেলার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

বিমানসূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে সকাল ৯টায় বিমানটি টেকঅফ করে। ৪ ঘণ্টা ২৮ মিনিট পরে বিমানটি যখন তুর্কমেনিস্তানের আকাশসীমায় প্রবেশ করে, তখন পাইলট ককপিটের মনিটরে লক্ষ্য করেন, বাম পাশের ইঞ্জিনে অয়েলের প্রেসার কমে গেছে। এ বিমানটির সঙ্গে অপারেশন কন্ট্রোল রুমের কম্পিউটার সংযুক্ত। এই মেসেজ বাংলাদেশ বিমানের অপারেশন কন্ট্রোল রুমে যায় বাংলাদেশ সময় দুপুর দেড়টায়। পাইলট বিমানে বসে লিখলেই অপারেশন কন্ট্রোল রুমে কম্পিউটারে রিয়েল টাইমেই চলে আসে। এ তথ্য পেয়ে অপারেশন কন্ট্রোল রুম থেকে সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং টিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং টিম তখন কাছাকাছি বিমানবন্দরে দ্রুত ল্যান্ড করার পরামর্শ দেয়। বিমানটি বেলা সোয়া ২টায় আশখাবাদ বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানেই গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন চারজন। তারা তখন সেখানে বিমানটির ত্রুটি অনুসন্ধান করে দেখেন লুব্রিক্যান্ট অয়েল পড়ে গেছে। তারা দেখতে পান চুয়ে চুয়ে পড়ার কারণে ইঞ্জিনের গায়ে লুব্রিক্যান্ট লেগে আছে। কোন স্থান দিয়ে লুব্রিক্যান্ট পড়ছে খুঁজতে গিয়ে গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়াররা দেখতে পান, এক জায়গার একটি নাট ঢিলা হয়ে আছে। সেই নাটটি টাইট করে তারা আবার লুব্রিক্যান্ট ভরে দেন। এরপর দুবার বিমানটি টেস্ট রান করে দেখা হয় লুব্রিক্যান্ট বের হচ্ছে কিনা।

সর্বশেষ খবর