বৃহস্পতিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সফটওয়্যার রপ্তানিতে রেকর্ড

দেশে তথ্যপ্রযুক্তি পেশাজীবী ৭ লাখ ৭০০ মিলিয়ন ডলার আয় পাঁচ বিলিয়ন ডলারের হাতছানি

রুহুল আমিন রাসেল

সফটওয়্যার রপ্তানিতে রেকর্ড

তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে চলা বাংলাদেশ এবার সফটওয়্যার রপ্তানিতে রেকর্ড করেছে। মধ্যম আয়ের দেশ গড়ার স্বপ্নে বিভোর বর্তমান সরকার ২০২১ সালে এ খাতে পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানির সম্ভাবনা দেখছে। বিশ্বে এখন সফটওয়্যার খাতের কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারের বাজার আছে। তবে বাংলাদেশ প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সফটওয়্যার পণ্য রপ্তানি করছে বলে জানা গেছে।

সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ (আইসিটি) এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সফটওয়্যার পণ্য রপ্তানির কথা বলা হলেও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা। সংস্থাটির তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৫১ দশমিক ৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সফটওয়্যার রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এমন বাস্তবতায় সরকারের লক্ষ্য সফটওয়্যার রপ্তানি প্রসারিত করে ২০২১ সালে পাঁচ বিলিয়ন ডলারে উন্নীতকরণ। সরকারের এ লক্ষ্য অর্জনে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ইতিবাচক ব্র্যান্ডিং চান সফটওয়্যার রপ্তানিতে জড়িত উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, সফটওয়্যার রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশে উন্নীত করা গেলেই ২০২১ সালে ৫ বিলিয়ন রপ্তানি আয় সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে রপ্তানি বাজার তৈরিতে সরকারের বিনিয়োগও চান সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে বেসিসের সভাপতি ও বিশিষ্ট তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তফা জব্বার গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সফটওয়্যার রপ্তানির সঠিক তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকে নেই। ফলে তাদের হিসাবে রপ্তানির পরিমাণ দেখানো হয় প্রায় ১৫২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের। এ তথ্য সঠিক নয় তা বাংলাদেশ ব্যাংকও স্বীকার করেছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ৭০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সফটওয়্যার রপ্তানি করেছে। দেশের সব ব্যাংক সঠিক তথ্য দেয় না দাবি করে তিনি বলেন, সফটওয়্যার রপ্তানির সব অর্থ দেশে আসছে না। আমার জানামতে, অনেক ছোট ও বড় কোম্পানি অর্থ দেশে আনছে না। বরং ওই অর্থ দিয়ে তারা বিদেশে তাদের রপ্তানিবাজার তৈরি করছে। সফটওয়্যার রপ্তানিকারকরা করমুক্ত সুবিধা প্রকৃত অর্থে ভোগ করতে পারছেন না বলেও মনে করেন এই প্রযুক্তি উদ্যোক্তা। বেসিসের সাবেক সভাপতি শামীম আহসান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের উদ্যোক্তারা পিছিয়ে নেই। তারা এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বিশ্ববাজার একটি প্রতিযোগিতামূলক জায়গা। এখানে ব্র্যান্ডিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো তাদের ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে ব্যবহার করছে। কিন্তু আমাদের বেলায় উল্টো চিত্র দেখা গেছে। বিশ্ব মিডিয়ায় আমাদের ইতিবাচক ব্র্যান্ডিং নেই। আছে নেতিবাচক। এ ছাড়া আমাদের দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তিন ধরনের করারোপ ব্যবস্থা প্রচলিত। ইন্টারনেট সেবার মূল্য বেশি হওয়ায় সফটওয়্যার শিল্পের প্রকৃত বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জানা গেছে, সরকার ২০১৮ সালে সফটওয়্যার রপ্তানি এক বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায়। এ লক্ষ্যে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে তরুণ উদ্যোক্তা ও পেশাজীবী তৈরির কাজ করছে সরকার। এ ছাড়া কারওয়ান বাজারের বহুল আলোচিত জনতা টাওয়ারে সফটওয়্যার পার্কে স্বল্পমূল্যে অফিস সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।

সফটওয়্যার কী : সফটওয়্যার হলো কিছু প্রোগ্রামের সমষ্টি, যা কম্পিউটারকে নির্দেশ করে কী করতে হবে আর কীভাবে করতে হবে। এক বা একাধিক লোক কোনো একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে বা কিছু সমস্যা সমাধানের জন্য সফটওয়্যার ব্যবহারযোগ্য করে তোলে। সফটওয়্যার ব্যবহারের বড় একটি উদ্দেশ্য হলো, কোনো প্রতিষ্ঠানের লোকবলকে যথযথভাবে কাজে লাগিয়ে নির্ভুল ও নিখুঁত তথ্য সর্বোচ্চ ত্বরিত গতিতে পাওয়া। সঙ্গে আছে তথ্য বা ডেটা সংরক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কম্পিউটার বিশেষজ্ঞরা সফটওয়্যারের উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘আজ যদি মাইক্রোসফট অফিস না থাকত, তাহলে আপনাকে সেই পুরনো টাইপ রাইটারে সারা দিন ধরে কাজ করে এক পৃষ্ঠা প্রিন্ট দিতে হতো। কিন্তু মাইক্রোসফট অফিস এটিকে এখন এমন সাবলীল করে দিয়েছে, আপনি যখন-তখন শত শত পৃষ্ঠা প্রিন্ট ও টাইপ করতে পারবেন। অথবা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সারা বছরের হিসাব-নিকাশের যে খতিয়ান, তা কয়েক মিনিটেই দিতে পারে এই সফটওয়্যার, যা হাতে-কলমে করতে অনেক সময় লাগবে। সব মিলিয়ে এক কথায় বলা যায়, আপনি সফটওয়্যার ছাড়া আধুনিক জীবনে প্রায় অচল। বর্তমানে প্রতিদিনকার জীবনযাপনে সফটওয়্যার আমাদের ঘিরে রেখেছে।’ দেশের তথ্যপ্রযুক্তিবিদরা জানিয়েছেন, বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া আউটসোর্সিংও সফটওয়্যার রপ্তানির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

আউটসোর্সিং কী : আউটসোর্সিং মানে বাইরের মাধ্যম থেকে কোনো কাজ বা তথ্য নিজের কাছে নিয়ে আসা বা নিজের কাজ বা তথ্য অন্যের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে তুলনামূলক কম মূল্যে করিয়ে নেওয়া। শুধু ফ্রিলান্সিংকে এককভাবে আউটসোর্সিং বলা চলে না। স্থানীয় বা নিজ দেশের কাজকেও আউটসোর্সিং বলা যাবে না। বাংলাদেশ আউটসোর্সিংয়ে বর্তমানে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে জানিয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, ‘আমরা এ খাতে আরও এগিয়ে যাব। আগামীতে আউটসোর্সিংয়ের জন্য ৫০ হাজার ছেলে-মেয়েকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা হবে।’ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আয় পোশাকশিল্পকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

সরকারি তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ৭ লাখ তথ্যপ্রযুক্তি পেশাজীবী আছেন। এর মধ্যে ১ লাখ ২০ হাজার ও অন্যান্য খাতে ১ লাখ ৩০ হাজার মিলিয়ে মোট ২ লাখ ৫০ হাজার তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর পেশাজীবী রয়েছে বলে জরিপ করে জানিয়েছে বেসিস। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর পেশাজীবী ছাড়াও দেশে ফ্রিল্যান্স-আউটসোর্সিংয়ে জড়িত আছেন প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষ। সরকারি-বেসরকারিভাবে প্রায় দুই লাখ তথ্যপ্রযুক্তি পেশাজীবী তৈরির প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। তবে ২০১৮ সালের মধ্যে দেশে ১০ লাখ তথ্যপ্রযুক্তি পেশাজীবী তৈরির ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এতে সরকারের চলমান উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন ও সামনের দিনগুলোতে ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এই ১০ লাখ পেশাজীবী তৈরি ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা সম্ভব। বেসিস জানিয়েছে, রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ১ শতাংশ অবদান রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে রপ্তানি আয় প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলো প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশ ব্যাংকের সি-ফর্মের জটিলতায় এটি সরকারি হিসাবে প্রায় ১৩২ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এ আয় প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার। এর সঙ্গে ফ্রিল্যান্স-আউটসোর্সিং পেশাজীবীরা প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার আয় করছে। এ ছাড়া দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের স্থানীয় বাজার প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মোট বাজার প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলার। এটা দেশের জিডিপির প্রায় শূন্য দশমিক ৫২ শতাংশ।

সর্বশেষ খবর