শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

জামাল হটলেও হচ্ছে না রাহুমুক্ত

সাঈদুর রহমান রিমন

জামাল হটলেও হচ্ছে না রাহুমুক্ত

নানা কারণে বিতর্কিত জামাল উদ্দিনকে বাংলাদেশ বিমানের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়েও রাহুমুক্তি ঘটেনি বিমানের। ঘাটে ঘাটে দুর্নীতি আর সীমাহীন অব্যবস্থাপনায় কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এ প্রতিষ্ঠান। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, অলীক ক্ষমতাধর সিবিএ নেতা এবং প্রভাবশালী চোরাকারবারিদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা মাফিয়া চক্রের হাতে বিমান রীতিমতো জিম্মি হয়ে পড়েছে। দুর্নীতিবাজ চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেছেন বেসামারিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। সম্প্রতি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) মিলনায়তনে ‘মিট দ্য রিপোর্টার্স’ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির কারণেই কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসছে না বিমানের। আমি মনে করি, সরকার এ ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে পারছে না। কর্মচারীদের বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নই সরকারি কর্মকাণ্ডকে নানা কূটকৌশলে ব্যর্থ করে দিচ্ছে।’ অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ বিমানে ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা দিন দিনই বেড়েই চলেছে। একইভাবে বাড়ছে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি। বর্তমানে দৃশ্য-অদৃশ্যমান অন্তত ১০টি ট্রেড ইউনিয়ন বা অ্যাসোসিয়েশন সেখানে সক্রিয়। এসব সংগঠনের দুই শতাধিক নেতা কাজ না করে ঘুরে বেড়ান। তারা প্রভাব খাটিয়ে কর্মচারীদের পছন্দমতো পদায়ন দিতে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করেন। যেসব জায়গায় অবৈধ টাকা, স্বর্ণ বা অন্যান্য পণ্য চোরাচালানের সুযোগ আছে, সেগুলো তারা নিয়ন্ত্রণ করেন। সিবিএ নেতাদের চাপাচাপিতে প্রতিবছর প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে জনবল নিয়োগ দেওয়া হয় বিমানে। গত আট বছরে অতিরিক্ত জনবলের কারণে গচ্চা গেছে ৪০০ কোটি টাকারও বেশি। বিমানের জনবল তিন হাজার ৪০০ থেকে নামিয়ে আনাসহ চারটি শর্তে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে কোম্পানি করা হয় ২০০৭ সালে। এ কোম্পানি করার আট বছর পর বিমানের জনবল উল্টো পাঁচ হাজার ৩৮ জনে উন্নীত হয়েছে। শ্রমিক-কর্মচারীদের ওভারটাইমের নামেও সেখানে চলে সীমাহীন লুটপাট। বিমানের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মূল বেতনের ১৭২ শতাংশ সেখানে ভাতা হিসেবে খরচ হয়। ৪০ শতাংশ খরচ হয় ওভারটাইম হিসেবে। অনেকে মূল বেতনের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি ওভারটাইম বিল উত্তোলন করে থাকেন। এক বছরে শুধু ওভারটাইম খাতে বিমানকে গুনতে হয়েছে অতিরিক্ত ৪৬ কোটি টাকা। শিফটিং ডিউটি চালু করায় এ ক্ষতি ১২০ কোটি টাকা ছাড়াবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বিমানের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং সিইও কেভিন জন স্টিল চিঠি দিয়ে অভিযুক্ত সিবিএ নেতাদের তালিকা পাঠিয়েছিলেন দুদকে। তাদের বেতন-ভাতার সঙ্গে সম্পদের সমতা না থাকার বিষয়টি খতিয়ে দেখে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন তিনি। উল্টো কেভিন বিমান ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। বিমানের মতিঝিল সেলস অফিস, কার্গো বিভাগ, এয়ারপোর্ট সার্ভিস বিভাগ, বিক্রয় ও বিপণন পরিদফতর, ক্রয় পরিদফতর, যানবাহন উপবিভাগ, সিকিউরিটি ও তদন্ত বিভাগ, আসন রিজার্ভেশন বিভাগ, বিএফসিসি, বিমানের কর্মচারী নিয়োগ এবং প্রকৌশল বিভাগে বিপুল অঙ্কের চাঁদাবাজি হয় প্রতিনিয়ত। সূত্রমতে, এয়ারপোর্ট ট্রাফিক শাখার পাসপোর্ট চেকিং ইউনিটে (পিসিইউ) পদায়ন পেতে হলে প্রত্যেক কর্মচারীকে প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে তিন হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। এ শাখায়  পদায়ন নেওয়া একজন কর্মচারী প্রতিদিন আয় করেন সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত, যে কারণে ট্রাফিক বিভাগের অধিকাংশ কর্মচারীর ঢাকায় একাধিক বাড়ি-গাড়ি ও নামে-বেনামে সম্পদ রয়েছে। এ ছাড়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই লোক নিয়োগ হয় এ সংস্থায়। প্রতিটি নিয়োগের জন্য সিবিএ নেতাদের এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়।

দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিমানের ১০ বিভাগের ২৯ ঘাটে প্রতি মাসে শত কোটি টাকার লুটপাট হয়। শ্রমিক লীগের একজন প্রভাবশালী নেতাসহ ১১ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংঘবদ্ধ চক্র এই লুটপাটের হোতা। উড়োজাহাজ কেনা, লিজ নেওয়া, প্রয়োজনীয় কেনাকাটা, মেরামত, স্পেয়ার পার্টস কেনা, বিএফসিসি, পোলট্রি, টিকিট বিক্রি, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং, বৈদেশিক অফিস চালানোসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে চলে সীমাহীন লুটপাট। আধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগসহ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এনেও এসব লুটপাট বন্ধ করা যায়নি। পাশাপাশি বিমানের সিট রিজার্ভেশনের নামে ঘটে ভয়াবহ দুর্নীতি। এজেন্টদের কাছ থেকে সিট কনফার্মের নামে ফ্লাইটভিত্তিক লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। ট্রাভেল এজেন্ট, মার্কেটিং ও রিজার্ভেশন শাখায় সিন্ডিকেটের রীতিমতো স্থায়ী ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। লুটপাটের এ টাকা বিমান ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা কয়েকজন কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালী মহলের মধ্যেও বণ্টন হয়। ফলে অভিযুক্ত চক্রের সদস্যরা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিমানের অনেক কর্মচারী লুটপাট করে আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন।

বিমানেরই কয়েকজন দায়িত্বশীল জানান, কর্মচারী থেকে বোর্ড সদস্য—কোথাও টাকা ছাড়া কাজ হয় না। ফলে বেসরকারি ও বিদেশি এয়ারলাইনস যখন লাভ করছে, তখন বাংলাদেশ বিমানকে লোকসান গুনতে হচ্ছে শত শত কোটি টাকা।

সর্বশেষ খবর