শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

ওখানকার আইনকানুন কিছুটা আলাদা

সমরেশ মজুমদার

ওখানকার আইনকানুন কিছুটা আলাদা

আমার কলকাতায় থাকার বয়স পঞ্চাশে পড়ল। অথচ মনে হয় এই তো সেদিন এলাম।

পঞ্চাশটা বছর মানে অর্ধেক শতাব্দী। ভাবা যায়। এসেছিলাম কলেজে পড়তে। হিসাব মতো, আমি দুর্ঘটনায় মারা গেলে এখন খবরের কাগজে লেখা হবে, এক বৃদ্ধের মৃত্যু। কৈশোর এবং তরুণকালে পঞ্চাশ বছরের কোনো মানুষকে বেশ বুড়ো বলে মনে হতো। আমার বন্ধু মন্টি ওই বয়সেই খেঁকুড়ে মানুষদের দেখলে বলত, লোকটা শুঢঢা। সে সময় ষাট পার হলেই মানুষরা দুমদাম মরে যেত। চৌষট্টিতে লাঠি নিয়ে হাঁটত, সকালে বাজারে যেত, বিকালে পার্কে, সন্ধের পর আর বাড়ি থেকে বের হতো না। অথচ আমি, গত তিরিশ বছরের প্রতিটি দিন যেভাবে কাটিয়েছি ঠিক সেভাবে কাটাচ্ছি। দুপুর দেড়টায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাত ১০টায় ফিরছি আড্ডা এবং কাজকর্ম সেরে। কোথাও তো কোনো অসুবিধা হয় না।

এই কিছুদিন আগে বিদেশ থেকে দুই বন্ধু এসেছিলেন। প্রতিবছর ওদের ওখানে গেলে প্রচুর আপ্যায়ন করেন ওরা। যেদিন এলেন তার পরের দিন চলে যাবেন। বললেন, এখানে ভালো চিনে খাবার পাওয়া যায়, খাওয়াবেন? পার্ক স্ট্রিট ছাড়িয়ে সাদান অ্যাভিনিউ পর্যন্ত প্রচুর ভালো চিনে খাবারের রেস্তোরাঁ হয়েছে। তার কোনটায় যাওয়া যায় জানতে চাইলাম একজন খাদ্যরসিকের কাছে। তিনি বললেন, ‘কোথাও যেতে হবে না, ওদের নিয়ে যান চিনেপারায়। কীভাবে কোথায় যাবেন ম্যাপ এঁকে দিচ্ছি। এত ভালো খাবার কোথাও পাবেন না। তাছাড়া আপনার অতিথিরা কী পান করেন? বললাম, ‘খুব সামান্য। ওয়াইন জাতীয় হলে ভালো হয়।’

‘তা হলে ওখানেই যান। আজ কলকাতার কোনো রেস্তোরাঁয় হার্ড ড্রিঙ্কস পাবেন না। সরকারি আদেশে সব বন্ধ। একমাত্র ওখানেই পাবেন।’

‘সে কী! সব জায়গায় বন্ধ হলে ওখানে পাওয়া যাবে কেন?’

‘গিয়ে দেখুন। কলকাতার বুকে হলেও ওখানকার আইনকানুন কিছুটা আলাদা।’

এ ব্যাপারটা আমার জানা ছিল না। কলকাতায় এসে চিনেপাড়ার নাম আমি অবশ্যই শুনেছি কিন্তু কখনো যাওয়া হয়নি। অনেক কিছুই হয় না। যেমন আমি এখনো কালীঘাটের মন্দিরের ভিতরে যাইনি, গঙ্গাসাগর মেলা দেখিনি। চিনেপাড়ায় প্রথম গিয়েছিলাম সাতাশি সালে। তখন আমরা টিভি সিরিয়াল বানাচ্ছি। জোছন দস্তিদারের সঙ্গে তেরো পার্বণ করার পর আমি আর অরিজিৎ গুহ নতুন কোম্পানি তৈরি করে কলকাতা বলে একটা সিরিজ লিখছি। সে সময় দূরদর্শন ছাড়া অন্য কোনো চ্যানেল ছিল না। প্রযোজক সংস্থাও ছিল হাতেগোনা। আমাদের সিরিয়ালের গল্প-চিত্রনাট্য আমিই লিখতাম। একটি বহুতল বাড়ির ফ্ল্যাট কিনছেন কলকাতার বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ। আবেদনপত্র জমা পড়ার পর লটারি হবে। ওই বাড়ির কেয়ারটেকার নিবারণ ঢোল আবেদনকারীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিটিংয়ের নোটিস দিয়ে আসছে। ওইসব আবেদনকারীর মধ্যে এক চিনা দম্পতিও রেখেছিলাম। কলকাতায় বাঙালি ছাড়া মাড়োয়ারি, পার্শি, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান যেমন থাকেন চিনারাও আছেন। হঠাৎ খেয়াল হলো আমি চিনাদের সম্পর্কে কিছুই জানি না অথচ নিবারণ ঢোলকে চিঠি নিয়ে যেতে হবে চিনেপাড়ায়। খুব সমস্যায় পড়লাম। চিত্রনাট্য শেষ হলে শুটিং শুরু করবে রমাপ্রসাদ বণিক। আন্দাজ করে লিখলে ভুল হবেই। তখন, দিনে একটা সিরিয়াল দেখানো হতো বলে লোকে দেখতেন। ভুল থাকলে ছি ছি শুনতে হবে। রমাপ্রসাদ তার এক বন্ধুর খবর দিল যে চামড়ার ব্যবসা করে বলে ওই পাড়ায় যাতায়াত করে। তার সঙ্গে যোগাযোগ হলো। এক সকালে সে তার বাইকের পেছনে আমাকে বসিয়ে নিয়ে গেল চার নম্বর ব্রিজ পেরিয়ে বাইপাস ধরে এক চার রাস্তার মোড়ে। জিজ্ঞাসা করল, ‘সমরেশদা, বাঁদিকের রাস্তা ধরে গেলে ডানদিকে ঢুকতে হবে, সোজা গেলে বাঁদিকে। কোন পথে যাবেন?’

‘যে পথে গেলে অনেকটা দেখা যায়----’

সে আমাকে বাঁদিকের রাস্তা ধরে ডানদিকের গলিতে নিয়ে গেল। বেশ নোংরা রাস্তা। এক পাশে কাঁচা নর্দমা। ঢুকতেই একদল চিনে ছেলেকে দেখতে পেলাম। বাঁদিকের চিলতে মাঠের পর একতলা ঘর। শুনলাম ওটা নাকি মাতব্বরদের আলোচনার জায়গা। ইতিমধ্যে মানুষের মুখের চেহারা বদলে গেছে, কয়েকটি বিহারবাসীর আনাগোনা ছাড়া বাকিদের মুখে মঙ্গোলিয়ান ছাপ। আমরা এগোলাম। ডানদিকে বিরাট বিরাট চামড়ার কারখানার গেট। মনে হচ্ছিল শ্রমিকদের মধ্যে বিহারি আছেন প্রচুর। তারপর আরম্ভ হলো রেস্তোরাঁ পাড়া। ইংরেজির পাশে চিনে ভাষায় লেখা হোরড়িং চোখে পড়ল। একটু বাদেই দু’ধারে চামড়া শুকাতে দেওয়া হয়েছে দেখতে পেলাম। শুটিংয়ের জন্য আমাদের একটা চামড়ার কারখানার মালিকের বাড়ি দরকার ছিল। ছেলেটি ওর পরিচিত যে ব্যক্তির কাছে নিয়ে গেল তিনি কারখানার ভিতরেই থাকেন। খুব কটু গন্ধ নাকি আসছিল। ছেলেটি আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিল যেন নাকে রুমাল না দিই। তাতে নাকি ওদের অসম্মান করা হতে পারে।

মালিককে ছেলেটি শুটিংয়ের কথা বোঝালে তিনি জানালেন তখনই কিছু বলতে পারছেন না। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আলোচনা করে জানাবেন। লোকেশন হায়ার চার্জ বলে একটা টাকা বাজেটে ধরা আছে। তার কথা জানালেও কোনো হেলদোল হলো না।

কিন্তু অনুমতি পাওয়া গেল। শর্ট স্ট্রীটে ববি ইয়ং নামে একটি আধা চিনা আধা নেপালি ছেলে থাকত। তাকে এবং তার প্রেমিকাকে আমরা চিনা দম্পতির চরিত্রে নির্বাচিত করলাম। রমাপ্রসাদ ওদের অফিসে আনিয়ে রিহার্সাল দেওয়ালো কয়েকদিন ধরে।

কিন্তু শুটিংয়ের আগের সন্ধেতে রমাপ্রসাদ অসুস্থ হয়ে পড়ল। ফুড পয়েজনিং হওয়ায় বেচারা বিছানা থেকে উঠতে পারছিল না অথচ শুটিং বাতিল করার উপায় নেই। প্রথমত সব ব্যবস্থা হয়ে যাওয়ায় ভালো খরচ হয়েছে এবং ওই একটি দিন পরব থাকায় কারখানা বন্ধ রাখা হবে বলে শুটিংয়ের অনুমতি পাওয়া হয়েছে। পরে পাওয়া যাবে না।

অরিজিৎ আমাকে অনুরোধ করল, ‘তোমার গল্প, চিত্রনাট্য, তুমি কালকের শুটিংটা পরিচালনা করো। তিন-চার বছর ধরে তো সব দেখেছ।’

গল্প লেখা এক। চিত্রনাট্য আরেক। কিন্তু সেটাকে ক্যামেরার মাধ্যমে দর্শকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য হাতেকলমে অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা থাকা দরকার যার কোনোটাই আমার নেই। অথচ এক দিনের জন্য পরিচালনা করতে অন্য কোনো পরিচালক রাজি হবেন না। সেদিনই আমাদের নতুন ক্যামেরাম্যান যিশু দাশগুপ্তের হাতেখড়ি হবে।

এখনো ভাবি কী সাহসে সেদিন পরিচালক হিসেবে স্পটে গিয়েছিলাম। দৃশ্যগুলো কীভাবে নেব তা আলাদা কাগজে লিখে রেখেছিলাম। ম্যানেজার কেয়ারটেকার নিবারণ ঢোলকে নামিয়ে দিয়ে গেলেন বাইপাসের ধারে। প্রয়াত সুনীল সরকার ওই চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছিলেন। শুটিং চলছিল। কিন্তু ওই কাঁচা চামড়া শুকোচ্ছে যেখানে, সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় সুনীলবাবু পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকচাপা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন চিনা মহিলা তাঁদের ভাষায় চেঁচিয়ে উঠল। সেটা যে গালাগালি তাতে সন্দেহ রইল না। ভয় পেয়ে ক্যামেরা চালু থাকা সত্ত্বেও সুনীলবাবু বলে উঠলেন, ‘এই মেরেছে, মারবে না কি।’

ব্যাপারটা জানা থাকায় আমি এগিয়ে গিয়ে মহিলাদের কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলাম। তারা একটু শান্ত হলে সুনীলবাবুকে বললাম, ‘আবার টেক করছি, দয়া করে নাকে রুমাল দেবেন না। ওরা পছন্দ করছেন না।’

‘কিন্তু তা হলে আমার বমি পেয়ে যাবে। টেকনিশিয়ানরা তো নাকে রুমাল বেঁধে কাজ করছে, ওইভাবে বাঁধি?’

‘না। আপনার চরিত্র ওইভাবে নাকে রুমাল বাঁধতে পারে না।’

অনেক চেষ্টার পর দৃশ্যটা নেওয়া গেল। আমরা কারখানার ভিতরে ঢুকলাম, হঠাৎ দুজন চিনা ভদ্রলোক এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ববি ইয়ং যে চরিত্রে কাজ করছে সেটা কি চিনে চরিত্র? তাহলে আমাদের আপত্তি আছে। ও পুরো চিনা নয়। আর ওর বউয়ের মুখ চিনেদের মতন বটে কিন্তু ও অ্যাংলো ইন্ডিয়ান।’

পরিস্থিতি বাঁচাতে আমাদের প্রোডাকশন ম্যানেজার অর্ধসত্য বলল, ‘ওরা মোটেই চিনে নয়। নেপালি। এই ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে।’ এতে খুশি হলেন ভদ্রলোকেরা।

সারাদিন ঠায় দাঁড়িয়ে শুটিং করতে যে কী পরিশ্রম হয় তা সেদিন টের পেয়েছিলাম। বিকালে শুটিং শেষ হলে একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেলাম। একটি গর্ভবতী কুকুর হেলতে-দুলতে চলেছে আর তার পিছনে খানিকটা দূরত্ব রেখে চার-পাঁচ বছর বয়সের চিনে ছেলে পাহারা দিতে দিতে চলেছে। কুকুরটাকে চোখের আড়ালে যেতে দিচ্ছে না ওরা। অনেক দূরে কয়েকটা চিনা বালক দাঁড়িয়ে এদের দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে। প্রথমে কারণটা ধরতে পারিনি, প্রোডাকশন ম্যানেজার খবরটা জানাল। ওই কুকুরটির শিগগির বাচ্চা হবে। সেই বাচ্চাদের একটিকে রেখে বাকিগুলোর মাংসের ওপর ওদের লোভ এত প্রবল যে চোখ ছাড়া করছে না কুকুরটাকে। করলেই আর একটা দল, যারা দূরে দাঁড়িয়ে আছে তারা দখল নিয়ে নেবে। উত্তর-পূর্ব ভারতের কোনো কোনো রাজ্যে কুকুরের মাংস খাওয়ার চল আছে। পূর্ব এশিয়াতে কুকুর তো বটেই সাপ ব্যাঙ থেকে শুরু করে অনেককিছুর মাংস মানুষ খান যা আমরা ভাবতেও পারব না। কলকাতা শহরের বুকে তো নয়ই। সুনীলবাবু খুব পিটপিটে এবং ভীতু মানুষ ছিলেন। দীর্ঘকাল বহুরূপীতে নাটক করেও কী রকম আড়ষ্ট হয়ে থাকতেন। এসব দেখেশুনে ম্যানেজারকে আলাদা ডেকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘হ্যাঁগো, আমরা তো এখন বাংলাদেশে নেই, চিনে আছি। লাঞ্চে যেটা খাসির মাংস দিয়েছিল সেটা সত্যি খাসির মাংস তো?’

সর্বশেষ খবর