শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বস্ত্র খাতে বিশ্বজয় রূপকথা নয়

রুহুল আমিন রাসেল

বস্ত্র খাতে বিশ্বজয় রূপকথা নয়

রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রাম ও যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রালগ্নে সংকটের অন্ত ছিল না। খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদার সঙ্গে ছিল বস্ত্রেরও অভাব। সংকটের আবর্তে ডুবে থাকা মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশ ৪৫তম বিজয় দিবসের অনেক আগেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আজ আর রূপকথা নয়, বাংলাদেশের বস্ত্র খাতের বিশ্বজয়। কেবল বাংলার দামাল ছেলেরা নয়, এখন বিশ্ববাসী পড়েন ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ খ্যাত তৈরি পোশাকপণ্য। এ খাতের রপ্তানিতে এখন বিশ্বে দ্বিতীয় হলেও এক নম্বর হওয়ার হাতছানিতে বাংলাদেশ। বস্ত্র ও টেক্সটাইল খাতের অবদান সম্পর্কিত বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) পাওয়া তথ্য-উপাত্তে দেখা গেছে, দেশের প্রায় ১ হাজার ৫০০ কারখানায় বর্তমানে টেক্সটাইল খাতে উদ্যোক্তাদের প্রাথমিক বিনিয়োগ ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। উৎপাদন পর্যায়ে ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজন করে টেক্সটাইল খাত। মোট দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি জিডিপিতে টেক্সটাইল খাতের অবদান ১৩ শতাংশের বেশি। আর বস্ত্র খাতের ৭ দশমিক ৮১ শতাংশ থেকে ২০২১ সালে সরকারের লক্ষ্য ১১ দশমিক ২৫ শতাংশে উন্নীত করা। বর্তমানে বস্ত্র ও পোশাকশিল্প থেকে রপ্তানি আয়ের ৮১ দশমিক ১৬ শতাংশ আসে। এমন প্রেক্ষাপটে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ কাদের সরকার গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৯০ শতাংশ বস্ত্র খাত থেকে অর্জন হবে। সরকার এ খাতের রপ্তানি বাড়াতে সার্বিকভাবে আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে আসছে। অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত সর্বশেষ ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৬’ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, দেশের প্রাথমিক বস্ত্রশিল্প বর্তমানে অভ্যন্তরীণ চাহিদার সিংহভাগ ও রপ্তানিমুখী নিট এবং ওভেন পোশাকের প্রয়োজনীয় বস্ত্রের যথাক্রমে ৮০ থেকে ৮৫ ও ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ মেটাতে সক্ষম। বস্ত্র ও তৈরি পোশাকশিল্পে ৫০ লক্ষাধিক জনবল নিয়োজিত আছে। তবে দেশের বস্ত্র খাতে সুতা ও কাপড় উৎপাদনে সিংহভাগ শিল্প কারখানাই বেসরকারি খাতে পরিচালিত। রাষ্ট্রায়ত্ত ২২ ও বেসরকারি খাতের ৪০৭ মিলিয়ে দেশের মোট স্পিনিং মিলের সংখ্যা এখন ৪২৯টি। এসব মিল প্রতি বছর ২ হাজার ১০৬ মিলিয়ন কেজি সুতা উৎপাদন করে। বর্তমানে দেশে ৭৮৭টি উইভিং মিল, ৩৮ হাজার ১০০ স্পেশালাইজড টেক্সটাইল ও পাওয়ার লুম এবং ৩ লাখ ১৩ হাজার ২৪৫টি হস্তচালিত ইউনিট আছে। এ ছাড়া সর্বমোট ৩ হাজার নিটিং, ১ হাজার ৪০০ রপ্তানিমুখী নিট-ডাইং ইউনিট এবং ২৩৬টি ডাইং প্রিন্টিং ও ফিনিশিং ইউনিট রয়েছে।

তাঁত বোর্ডের তথ্য : দেশের তাঁতশিল্প বছরে প্রায় ৬৮ কোটি ৭০ লাখ মিটার তাঁতবস্ত্র উৎপাদন হয়। অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৪০ শতাংশের বেশি জোগান দিচ্ছে তাঁতশিল্প। এ শিল্পে প্রায় ৯ লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ ও প্রায় ৬ লাখের পরোক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে। আর দেশে মোট তাঁতের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ ৬ হাজার। এর মধ্যে প্রায় ৩ লাখ ১৩ হাজার তাঁত সচল হলেও অচল প্রায় ১ লাখ ৯২ হাজার। মূলত চলতি মূলধনের অভাবেই তাঁত অচল রয়েছে। এ শিল্পের মূল্য সংযোজনের পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ২২৭ কোটি টাকা।

তুলা উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, ২০২১ সালে দেশে তুলার চাহিদা তৈরি হবে প্রায় ১ কোটি বেল (১৮২ কেজিতে ১ বেল)। তবে ওই সময় মোট চাহিদার ১৫ শতাংশ বা কিছু বেশি দেশে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের স্পিনিং ও অন্যান্য খাতে বছরে মোট তুলার চাহিদা ৫০ লাখ বেল। তবে দেশে উৎপাদন মাত্র দেড় লাখ বেল, যা চাহিদার তুলনায় ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। বাকি সাড়ে ৪৮ লাখ বেল বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ ভারত, চীন, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাম্বিয়া, মালি ও জিম্বাবুয়ে থেকে তুলা আমদানি করে। এদিকে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্পের বিশাল সম্ভাবনা তুলে ধরে ইন্টারন্যাশনাল কটন অ্যাসোসিয়েশনের (আইসিএ) বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বলছে, বিশ্বব্যাপী বস্ত্র খাতের চাহিদা যেমন বাড়ছে, তেমন তুলাশিল্পের সুরক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। চাহিদার বেশির ভাগ তুলাই আমদানি করছে বাংলাদেশ। তাই বস্ত্রশিল্পে বড় সম্ভাবনা রয়েছে এ দেশে। বর্তমানে বাংলাদেশের বাজারে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের তুলার বাণিজ্য হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ১২ বিলিয়ন ডলারের তুলার বাণিজ্য হয় আইসিএ নীতিমালার অধীন। বাংলাদেশে যে হারে পোশাকশিল্প এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে তুলার চাহিদাও বাড়ছে। বস্ত্র উৎপাদনে ফাইবার বা কৃত্রিম আঁশ বড় অংশ দখল করে আছে। বস্ত্রশিল্পের প্রসারে পণ্যের গুণগত মান উন্নয়নসহ তুলার ব্যবহারে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে জানিয়েছে আইসিএ।

সর্বশেষ খবর