রবিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

আলাদা বিমানের প্রস্তাব নাকচ

নিজস্ব প্রতিবেদক

আলাদা বিমানের প্রস্তাব নাকচ

দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের নিরাপদ ভ্রমণের জন্য আলাদা নতুন উড়োজাহাজ কেনার পরিকল্পনা বিলাসিতা বলে তা নাকচ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর জন্য নতুন এয়ারক্রাফ্ট কেনার বিলাসিতার সময় আমাদের এখনো হয়নি। গরিবের ঘোড়ারোগ না হওয়াই ভালো। ঘোড়া লালন-পালনে যথেষ্ট খরচ। এর প্রয়োজন নেই। আমি চাইও না।’

হাঙ্গেরি সফর থেকে ফেরার পর গতকাল বিকালে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে নতুন উড়োজাহাজ কেনাসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যে বিমানে সাধারণ মানুষ চড়েন, সে বিমানেই চড়ব। আমি সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতি করি। তারা যেভাবে যাতায়াত করেন, আমি তাদের মতোই চলব।’

সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মঞ্চে ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে তার হাঙ্গেরি ও মরক্কো সফরের নানা দিক তুলে ধরেন। প্রাসঙ্গিকভাবেই হাঙ্গেরি সফরের সময় তাকে বহনকারী বিমানের যান্ত্রিক গোলযোগের বিষয়টিও উঠে আসে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন ছিল— বিমানে যে ঘটনা ঘটেছে, তা নিছকই দুর্ঘটনা, নাকি অন্য কিছু?

প্রধানমন্ত্রী একটি কবিতার দুটি চরণ উদ্ধৃত করে তার জবাব শুরু করেন। তিনি উদ্ধৃত করেন, ‘জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্য, বুঝেছে দুর্বৃত্ত’। এরপর বলেন, ‘এটা একটা যান্ত্রিক দুর্যোগ ছিল। দুর্ঘটনা ঘটেনি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। সহি-সালামতে বেঁচে আছি, আপনাদের সামনে আছি। এটাই গুরুত্বপূর্ণ। দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।’ তিনি বলেন, অ্যাক্সিডেন্ট তো হয়ই। ব্রাজিলে ফুটবল প্লেয়ারসহ প্লেন ক্র্যাশ করল। অ্যাক্সিডেন্ট, এজন্যই অ্যাক্সিডেন্ট। এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তবে অ?্যাক্সিডেন্ট যান্ত্রিক ত্রুটির জন্যও হতে পারে, আবার মনুষ্যসৃষ্টও হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘যে দেশে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয় না, বরং তাদের মন্ত্রী করা হয়, সেখানে আর কী বলব। আমার বাবা-মাকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর ঝুঁকি নিয়েই মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমি এসেছি। ঝুঁকির মধ্যে আছি, চলতে থাকব।’

খালেদার প্রস্তাব রাষ্ট্রপতি দেখবেন : নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রস্তাবসংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘উনার প্রস্তাব উনি দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতিকে বলুক, তিনিই (রাষ্ট্রপতি) ব্যবস্থা নেবেন। এই নির্বাচন কমিশন আমরা সরকার থেকে করিনি। সার্চ কমিটি করেই করা হয়েছে। তখন তাদের যা দাবি ছিল, তা মেনে সেভাবেই করা হয়েছিল। সে প্রক্রিয়াই অনুসরণ করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন আছে, নির্বাচনও হচ্ছে। তারা (বিএনপি) আজ নির্বাচনে যাবে, কাল যাবে না। নির্বাচনে যখন জয়ী হয়েছে, তখন ভালো, আর হারলেই ভালো না। বিগত পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জয়লাভের পর নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপি কোনো প্রশ্ন তোলেনি। অথচ জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, বিএনপি যখন ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছিল তা কি স্মরণ আছে? তার (খালেদা জিয়া) নির্দেশে দেশব্যাপী মানুষ পুড়িয়ে হত্যা, বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। এখন তিনি প্রস্তাব দিচ্ছেন। আগে মানুষ হত্যার জবাব দিন, পরে প্রস্তাব নিয়ে কথা হবে। হাসতে হাসতে বিএনপি নেত্রীকে উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু সাজুগুজু করে বসে থাকলে চলবে না। কোনো রাজনৈতিক নেতার যদি সিদ্ধান্ত দেওয়ার হিম্মত না থাকে, তাহলে আর কী করার আছে? তিনি বলেন, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) নতুন করে কী প্রস্তাব দিয়েছেন, আমি জানি না। আপনারা মাথা বা লেজের কোনো হদিস পেয়েছেন কিনা? আপনারা সাংবাদিকরা সেখানে প্রশ্ন করে ব্যাখ্যা চাওয়ারও সুযোগ পাননি। এটাই বাস্তবতা।’ স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত যারা সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে, সেসব দলের সঙ্গে আলোচনার ব্যাপারে খালেদা জিয়ার প্রস্তাব নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) একেবারে সেই ’৭২-এর পর থেকে যত পার্টি আছে, তার মানে ফ্রিডম পার্টি থেকে শুরু করে জামায়াতকে নিয়ে কথা বলতে চান। তার মনের ভাব বোঝা গেল, তিনি কী চাচ্ছেন। কর্নেল রশিদ, হুদাকে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোট করে তিনি সংসদে বসিয়েছিলেন। আর স্বাধীনতাবিরোধী আলবদর বাহিনীর প্রধানদের মন্ত্রী বানিয়ে লাখো শহীদের পতাকা তুলে দিয়েছিলেন। তার প্রস্তাব নিয়ে এত তোলপাড় করার কী আছে, আমি বুঝি না।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ ধরনের অভদ্র যারা, তারা কী প্রস্তাব দিল, না দিল, ওটা নিয়ে আমার মতামত চান কেন? এ ধরনের ছোটলোকি যারা করে তাদের মতামত নিয়ে কোনো মতামত দেওয়ার আমার কোনো অভিপ্রায় নেই।’

মধ্যবর্তী নয়, পার হয়ে এসেছি : এক সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, বিভিন্ন টক-শোয় অনেকেই মধ্যবর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনা দেখতে পান। আপনি পান কিনা? জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন আর মধ্য নেই। মধ্য পার হয়ে গেছে। আমরা তিন বছর পার করছি। মধ্যবর্তী যদি বলেও থাকেন, তা পরবর্তী নির্বাচন বিষয়ে বলেছেন। তবে স্বপ্ন দেখা ভালো।’

মিয়ানমারের কোনো সন্ত্রাসীকে ঠাঁই দেওয়া হবে না : মিয়ানমারে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে এসে বাংলাদেশে কেউ ঠাঁই পাবে না বলে সতর্ক করে দেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, প্রথমে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ক্যাম্পে হামলা হলো। তাদের ৯ বিজিপি সদস্যকে হত্যা করা হলো। সেখানে ১০০ আর্মি গেল, তাদের ওপরও হামলা হলো। এখান থেকেই ঘটনার সূত্রপাত। দোষ দিতে হলে যারা প্রথমে সূত্রপাতটা করেছিল, তাদের ব্যাপারে আরও চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। তারা কোথায় আছে, তাদের ধরিয়ে দেওয়া উচিত। তাদের কারণেই হাজার হাজার নারী-পুরুষ কষ্ট পাচ্ছে। এটাই দুঃখজনক। এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে বাংলাদেশে এসে কেউ আশ্রয় পাবে না। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে তিনি বলেন, সেখানে তো মানুষ কষ্টে আছে। এ ধরনের ঘটনা কাদের জন্য হচ্ছে এবং কারা করছে এ ব্যাপারে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের আরও একটু সোচ্চার হওয়া উচিত ছিল। তিনি বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে। সীমান্তরক্ষী বাহিনী সজাগ রয়েছে। দেশটির রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এ ব্যাপারে কথা বলা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষ যখন একেবারে অসহায় হয়ে পড়ে, তখন তাদের আর আশ্রয় না দিয়ে উপায় থাকে না। এটাই বাস্তবতা।

তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে আশাবাদ : আসন্ন ভারত সফরে তিস্তা চুক্তি সইয়ের সম্ভাবনা আছে কিনা— এ প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কোনো শর্ত নিয়ে ভারত যাচ্ছি না। ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ। দেশটি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে সহযোগিতা করেছে, তা কারও ভুলে যাওয়া উচিত নয়। আমরা ক্ষমতায় এসে ভারতের সঙ্গে গঙ্গার দীর্ঘমেয়াদি ঐতিহাসিক পানিবণ্টন চুক্তি করেছি। এখন তিস্তা চুক্তি নিয়েও আলোচনা চলছে। এ ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। কেবল তিস্তা নয়, অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানিবণ্টন নিয়েও আলোচনা চলছে।’ জাতীয় সংসদ ভবনের মূল নকশা আনাসংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন স্থপতি লুই আই কানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি সৃষ্টি। অনেকে এ সম্পর্কে জানতে চান। তাই আমরা উদ্যোগ নিয়ে মূল নকশার চারটি কপি এনেছি। একে আর্কাইভে দেব, প্রদর্শনের ব্যবস্থা করব।’ তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে স্পিকারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আপাতত এটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হবে এবং এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক যা দরকার আমরা তা করব।’

ভারতে বাংলাদেশের চ্যানেল দেখাতে সে দেশের কর্তৃপক্ষকে অনেক টাকা দিতে হয়, কিন্তু ভারতের চ্যানেল অনায়াসে বাংলাদেশে দেখা যায়— এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিষয়টি ক্যাবল অপারেটররা করেন।

প্রতিবন্ধীদের জন্য কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ : গতকাল সকালে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ২৫তম আন্তর্জাতিক ও ১৮তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সরকার সব প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক ও বৃদ্ধদের রাষ্ট্রীয় সুরক্ষাব্যবস্থার আওতায় আনতে জীবনচক্রভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে; যাতে তারা আর দশটা স্বাভাবিক শিশুর সঙ্গে মিশে শিক্ষা লাভ করে সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত হতে পারে। তিনি বলেন, ‘রাস্তা, ফুটপাথ এবং নতুন অবকাঠামো যেখানেই হচ্ছে, সেখানে প্রতিবন্ধীদের সহজে চলাচলের জন্য পৃথক লেন এমনকি টয়লেট তৈরিরও নির্দেশ দেওয়া আছে এবং সেভাবেই আমরা করে যাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে আমি প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের জন্য পথ প্রশস্ত করতে করপোরেট সেক্টর, বিত্তবানসহ সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।’

সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মো. নুরুজ্জামান আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোজাম্মেল হোসেন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব জিল্লার রহমান বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ৩ ক্যাটাগরিতে ৯ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার মাঝে ক্রেস্ট ও সনদপত্র বিতরণ করেন।

 অনুষ্ঠানস্থল থেকে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হকের সঙ্গে কথা বলে মিরপুর ১৪ নম্বর সেকশনে প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণে আট দিনব্যাপী ‘প্রতিবন্ধী উত্তরণ মেলা’ উদ্বোধন করেন।

সর্বশেষ খবর