সোমবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বিদ্রোহীরা থাকছেন জেলায় জেলায়

দলের ঘোষিত প্রার্থীর বাইরে অন্যদের নিয়েও নমনীয় থাকবে আওয়ামী লীগ

রফিকুল ইসলাম রনি

জেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপিসহ বড় রাজনৈতিক দলগুলো অংশ না নেওয়ায় আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ এখন আওয়ামী লীগ। চেয়ারম্যান পদে ৩৫ জেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা ৫৫ জন প্রার্থীর সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতা। আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, গত জাতীয় সংসদ, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত অমান্যকারী বিদ্রোহী প্রার্থীরা শাস্তির মুখোমুখি হয়েছিলেন। তবে জেলা পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহীদের সরে দাঁড়াতে চাপ দেওয়া হবে না। নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতেই এই ছাড় দেওয়া হচ্ছে। ফলে জেলায় জেলায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী থাকছেনই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কিছু মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালী নেতার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইন্ধনে অনেকে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। গত শনিবার ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ কেন্দ্রীয় নেতারা অনানুষ্ঠানিক এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেন, নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। তবে দলীয় প্রার্থীকে জয়ী করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হবে। দলের দুজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিদ্রোহীদের ব্যাপারে নমনীয় থাকার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। দলের উচ্চপর্যায় চায়, যাদের দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তারা জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে বিজয়ী হয়ে আসুক।

জানা যায়, নির্বাচনকে ঘিরে ভোটারদের নানা প্রলোভন দেখাচ্ছেন প্রার্থীরা। প্রার্থীর প্রস্তাবক-সমর্থককে পর্যন্ত টাকা দিয়ে কেনা হচ্ছে। ভোটারদের টিভি-ফ্রিজ, মোটরসাইকেলসহ দামি জিনিসপত্র দেওয়ার প্রলোভন দেখানো হচ্ছে। একইভাবে নারী ভোটারদের শাড়ি, দেশি-বিদেশি শাল, গহনাসহ আকর্ষণীয়

 উপহার দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। নির্দিষ্ট প্রার্থীর ভোট নিশ্চিত করতে সিল দেওয়া ব্যালটের ছবি মোবাইল ফোনে তুলে আনার শর্তে ভোট কেনাবেচা হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ফলে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির প্রার্থীরা অনেকটা আতঙ্কে রয়েছেন। নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্র জানায়, জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মোট ১৯০, সদস্য পদে ৩৫৬১ এবং সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য পদের জন্য ৮৯৫ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। ১৬টি জেলায় চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হতে যাচ্ছেন। গতকাল মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষ হয়েছে। আগামী ১১ ডিসেম্বর মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ সময়। ভোটগ্রহণ ২৮ ডিসেম্বর। প্রত্যেক জেলার অন্তর্ভুক্ত সিটি করপোরেশনের (যদি থাকে) মেয়র ও কাউন্সিলর, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলর এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য জেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোটার হবেন। এ হিসাবে স্থানীয় সরকারের চার ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৬৭ হাজার নির্বাচিত প্রতিনিধি এ নির্বাচনে ভোট দেবেন। দলীয় সূত্রমতে, জামালপুর জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রার্থী পরিবর্তনের জন্য ৯০০ ভোটার (নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি) স্বাক্ষর সংবলিত একটি আবেদনপত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। এ জেলায় দলীয় সমর্থন পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এইচ আর জাহিদ আনোয়ার। প্রার্থীর নাম ঘোষণার পরপরই জামালপুরে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধারা সংবাদ সম্মেলন করে আনোয়ারকে রাজাকার পরিবারের সন্তান বলে উল্লেখ করেন। তারা জামালপুরে প্রার্থী প্রত্যাহার করে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহম্মেদ চৌধুরীকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার জন্য দলের সভানেত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছেন। এ বিষয়টি আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায় ওয়াকিবহাল রয়েছে বলে জানা গেছে। এ জেলায় ফারুক আহম্মেদ ছাড়াও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আতিকুর রহমান ছানা, সোহরাব হোসেন বাবুল এবং যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সরোয়ার জাহান। মাগুরায় আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পংকজ কুমার কুণ্ডু। তবে জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক রানা আমীর ওসমান এবং শ্রীপুর উপজেলা যুবলীগ সভাপতি ও স্থানীয় শ্রীকোল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান কুতুবুল্লাহ কুটি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তারা দুজনই একজন প্রতিমন্ত্রীর ছায়ায় রাজনীতি করেন। পাবনায় চেয়ারম্যান পদে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরিফ ডিলুর মেয়ে মেহজাবিন প্রিয়া। তিনি ঈশ্বরদী উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। এ পদ থেকে পদত্যাগ করে তিনি মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি নির্বাচনে থাকবেন বলে জানা গেছে। নোয়াখালীতে দলীয় সমর্থন পেয়েছেন এ বি এম জাফরুল্লাহ। এ জেলায় দুজন বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। তারা হলেন— আওয়ামী লীগ নেতা ডা. এ কে এম জাফর উল্লাহ ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ফখরুল ইসলাম মন্টু। বরিশাল জেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে চেয়ারম্যান পদে প্রথমে সমর্থন পেয়েছিলেন কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি খান আলতাফ হোসেন ভুলু। পরবর্তীতে তাকে পরিবর্তন করে সমর্থন দেওয়া হয় মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য মইদুল ইসলামকে। বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন আলতাফ হোসেন ভুলু, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. হোসেন চৌধুরী এবং বানারীপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান পদ থেকে সদ্য পদত্যাগকারী গোলাম ফারুক। রাজশাহী জেলায় চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী মাহবুব জামান ভুলু। সেখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী সরকার ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। সাতক্ষীরায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুনসুর আহমেদ মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় সমর্থন বঞ্চিত হয়ে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম। পটুয়াখালীতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন খান। বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক কাজী আলমগীর ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নূর মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। পিরোজপুরে দলীয় সমর্থন পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য শাহ আলম। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন মহারাজ ও সদর আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম আউয়ালের ভাই মশিউর রহমান মহারাজ। শেরপুরে আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন চন্দন কুমার পাল। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হুমায়ুন কবীর। কুড়িগ্রামে দল-সমর্থিত প্রার্থী জাফর আলী। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পনির উদ্দিন আহমেদ। শরীয়তপুরে খোকা সিকদার দলীয় সমর্থন পেয়েছেন। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি আবদুর রব মুন্সি। বগুড়ায় দলীয় সমর্থন পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মকবুল হোসেন। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সোলায়মান আলী। লক্ষ্মীপুরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শামছুল ইসলাম। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এম আলাউদ্দিন ও রামগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. শাহজাহান। মাদারীপুরে দলীয় সমর্থন পেয়েছেন বর্তমান প্রশাসক মিয়াজ উদ্দিন খান। বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সুজিত চ্যাটার্জি। রাজবাড়ীতে দলীয় প্রার্থী ফকীর আবদুল জব্বার। এখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা রকিবুল হাসান।

জেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে হাইকোর্টের রুল : জেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। রুলে জেলা পরিষদ নির্বাচনের ঘোষিত তফসিল কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক এবং বিচারপতি মোহাম্মদ উল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করে। আদালতে রিটের পক্ষে আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ, ঢাকা জেলা পরিষদের পক্ষে আইনজীবী নুরে আলম উজ্জ্বল ও রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তাপস কুমার বিশ্বাস। জেলা পরিষদ আইন ২০০০-এর ৪(২), ১৭ এবং ২০১৬ (সংশোধিত)-এর ৫ ধারা কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না, রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইন সচিব, স্থানীয় সরকার সচিব ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। এই রুলের সঙ্গে জেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে ২০০০ সালে জারি হওয়া রুলেরও শুনানি হবে বলে জানিয়েছে আদালত। আসন্ন জেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর গত ২৯ নভেম্বর ভোট স্থগিত ও জেলা পরিষদ আইনের তিনটি ধারা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন আইনজীবী ইউনুস আলী। তবে শুনানি শেষে আদালত রুল জারি করলেও নির্বাচনের স্থগিতাদেশ দেয়নি

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর