সোমবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

তিন বাংলাদেশি নারী ব্রিটিশ পার্লামেন্টে

জিন্নাতুন নূর

তিন বাংলাদেশি নারী ব্রিটিশ পার্লামেন্টে

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বর্তমানে প্রতিনিধিত্ব করছেন তিন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নারী। এর মধ্যে দুজন ছায়ামন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। আরেকজন বাংলাদেশ বিষয়ে বাণিজ্য দূত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।     

এই তিনজনই নির্বাচনে লেবার পার্টি থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই তিন ব্রিটিশ এমপি হলেন— রুশনারা আলী, টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক এবং রুপা হক। এদের মধ্যে রুশনারা দুবারই বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন নারীর ক্ষমতায়নসহ বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য সম্পর্ক শক্তিশালী করতে এই তিন কন্যাই কার্যকর ভূমিকা রাখবেন। নির্বাচনে প্রথমবারের মতো দাঁড়িয়ে চমক দেখিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নিজের জায়গা করে নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দিক। ব্রিটেন পার্লামেন্টে জয়ী আরেক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রুপা হক এর আগে মনোনয়ন পেলেও নির্বাচিত হননি। তবে ব্রিটেনের পার্লামেন্টে প্রথম বাঙালি হিসেবে নির্বাচিত এমপি রুশনারা আলী দ্বিতীয়বার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও বিপুল ভোটে জয়ী হন। এই তিন কন্যার বিজয় উপলক্ষে দেওয়া এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তিন কন্যার বিজয় ব্রিটিশ রাজনীতিতে অভিবাসী বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণকে গৌরবান্বিত করেছে। এই তিন কন্যাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদও। আর এই তিনজন ব্রিটিশ নারী সংসদ সদস্যকে  নির্বাচিত হওয়ার জন্য বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকেও ধন্যবাদ জানানো হয়। ডেমোক্রেসি ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী কর্মকর্তা তালেয়া রেহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যুক্তরাজ্যে গত বছরের পার্লামেন্ট নির্বাচনে বাংলাদেশি তিন কন্যার জয়ের বিষয়টি অত্যন্ত গর্বের। তার মতে, ব্রিটেনে বাঙালি মেয়েরা রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রে বেশ ভালো করছেন। একই ধারাবাহিকতায় এবার তিনজন বাঙালি নারী নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। এর মাধ্যমে ব্রিটেনে বাঙালি নারীরা আরও সামনে এগিয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন। বিশেষ করে আমরা এতদিন ধরে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কথা শুনেছি। এখন সেখানে আমাদের দেশের তিনজন নারী যখন বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলবেন তা নিঃসন্দেহে গর্বের বিষয়। চব্বিশ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন রুশনারা আলী। এর আগে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে সিলেটের রুশনারা ১১ হাজার ভোটে জয়ী হন। সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার লামাকাজি ইউনিয়নের প্রবাসী আফতাব আলী ও রানু বেগম দম্পতির দ্বিতীয় মেয়ে রুশনারা আলী। সাত বছর বয়সে ভূরকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালীন রুশনারা তার মা-বাবার সঙ্গে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। সেখানে লন্ডনের মালবেরি স্কুলে পড়ালেখা করেন। এরপর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনীতি, অর্থনীতি ও দর্শনশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রথমবার যুক্তরাজ্যের এমপি নির্বাচিত হয়ে রুশনারা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ও শিক্ষাবিষয়ক ছায়ামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ তিনি পার্লামেন্টারি ট্রেজারি সিলেক্ট কমিটির সদস্য হিসেবে মেয়াদ পূর্ণ করেন। রুশনারা দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়ে হাউস অব কমন্সের এনার্জি অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সদস্য মনোনীত হন। চলতি বছর বাংলাদেশ বিষয়ে বাণিজ্য দূত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন এমপি রুশনারা আলী। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী তাকে এই দায়িত্ব দেন। এর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে রুশনারা বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ব্রিটেনের মধ্যে ঐতিহাসিক বন্ধন আছে। বাংলাদেশ আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমার ভোটারদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত।’ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানার মেয়ে ৩২ বছর বয়সী টিউলিপ সিদ্দিক। টিউলিপ লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। গেল নির্বাচনে মোট ২৩ হাজার ৯৭৭ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। লন্ডনের মিচামে জন্মগ্রহণকারী টিউলিপের শৈশব কেটেছে বাংলাদেশ, ভারত ও সিঙ্গাপুরে। টিউলিপ ১৫ বছর বয়স থেকে লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্নে বাস করছেন। তিনি লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে পলিটিকস, পলিসি ও গভর্নমেন্ট বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এ ছাড়া অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গ্রেটার লন্ডন অথরিটি এবং সেইভ দ্য চিলড্রেনের সঙ্গেও কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। টিউলিপ ১৬ বছর বয়সে লেবার পার্টির সদস্য হন। আর ২০১০ সালে তিনি ক্যামডেন কাউন্সিলে প্রথম বাঙালি নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। কিছু দিন আগে ব্রিটেনের লেবার পার্টির ছায়া শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন টিউলিপ সিদ্দিক। এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর এটিই হবে টিউলিপের বড় মাপের দায়িত্ব। এর আগে ২০১৫ সালেও ব্রিটিশ লেবার পার্টির ছায়া মন্ত্রিপরিষদে সংস্কৃতি, গণমাধ্যম ও ক্রীড়া বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হিসেবে টিউলিপ দায়িত্ব পালন করেন। নবনির্বাচিত লেবার পার্টির দলীয় নেতা জেরেমি করবিন এবারও টিউলিপকে তার ছায়া মন্ত্রিসভায় জুনিয়র সদস্য হিসেবে স্থান দিয়েছেন। টিউলিপ বর্তমানে ব্রিটেনে ইহুদিবিদ্বেষী হয়রানির বিরুদ্ধে এক ধরনের কর্মসূচি চালিয়ে আসছেন। এদিকে প্যাচওয়ার্ক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে প্রতি বছর সেরা ব্রিটিশ এমপিদের মধ্যে চলতি বছর এমপি অব দ্য ইয়ার এর বাছাই তালিকাতেও স্থান করে নিয়েছেন টিউলিপ। আর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সেরা বক্তাদের তালিকাতেও স্থান পেয়েছেন টিউলিপ। বিবিসির র্যাংকিংয়ে টিউলিপের স্থান সপ্তম। ইউরোপীয় ইউনিয়ন রেফারেন্ডাম বিল-এর ওপর বিতর্ক চলাকালে টিউলিপ যে বক্তৃতা করেছিলেন সেটি তালিকায় স্থান পায়।  এটি ছিল হাউস অব কমন্সে তার দেওয়া প্রথম বক্তৃতা। এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর গত বছরের ২১ ডিসেম্বর বাংলাদেশে এসে এক অনুষ্ঠানে টিউলিপ বলেন, ‘রাজনীতিতে আসতে হলে আত্মবিশ্বাস প্রয়োজন। মানুষের জন্য কিছু করব বলেই আমি রাজনীতি করি।’ তিনি দেশের বাইরে থেকেও দেশের জন্য কাজ করে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তবে টিউলিপ ও রুশনারার মতো বিপুল ভোটে না হলেও হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে ২৭৪ ভোটের ব্যবধানে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে জয় পেয়ে নির্বাচিত হন আরেক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ড. রুপা হক। তিনি মোট ২২ হাজার ২ ভোট পান। ৪৩ বছর বয়সী রুপা ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উত্তর-পশ্চিম লন্ডনের ইলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড অ্যাকটন আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। রুপা হক কিংস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক। রুপার মা-বাবা ১৯৬০ সালে ব্রিটেন যান। ১৯৯১ সালে রুপা লেবার পার্টির সদস্য হন। ২০০৫ সালের নির্বাচনে চেশাম ও এমারশাম আসন থেকে লেবার পার্টির মনোনয়ন পেলেও নির্বাচিত হতে পারেননি রুপা। ১৯৭২ সালে রুপা ইলিংয়ে জন্ম নেন। রাজনীতি, সামাজিক বিজ্ঞান ও আইন বিষয়ে ক্যামব্রিজে শিক্ষাগ্রহণ করেন। এর আগে রুপা ডেপুটি মেয়র হিসেবে স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব পালন করেন। যুক্তরাজ্যের ইলিং সেন্ট্রাল ও অ্যাকটন আসন থেকে নির্বাচিত রুপা হকও ছায়ামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন। লেবার পার্টির নেতা জেরমি করবিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক ছায়ামন্ত্রী হিসেবে তার নাম ঘোষণা করেন। রুপার পৈতৃক নিবাস পাবনায়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর