শনিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

রাজউকের ব্যর্থতায় আবাসিক এখন বাণিজ্যিক এলাকা

সাঈদুর রহমান রিমন

আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউকের অভিযান থমকে আছে। সংস্থাটির নির্লিপ্ততায় অভিজাত আবাসিক এলাকাগুলো পুরোপুরি বাণিজ্যিক এলাকায় পরিণত হতে চলেছে। গুলশান, বনানী, উত্তরা, বারিধারায় বাসা-বাড়িগুলোতে স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, ব্যবসায়িক দফতরসহ গড়ে উঠছে সারি সারি দোকানপাট। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন রাজধানীর অবৈধ স্থাপনা ও দখলের বিরুদ্ধে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখলেও রাজউকের নীরবতায় কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসছে না। জানা যায়, গত ৪ এপ্রিল মন্ত্রিসভার বৈঠকে ছয় মাসের মধ্যে রাজধানীসহ সারা দেশের আবাসিক এলাকার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণের সিদ্ধান্ত হয়। প্রতি ১৫ দিন পর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে এ সংক্রান্ত সমন্বয় সভা করার কথা থাকলেও গত ১৬ মের পর কোনো সভা হয়নি। সর্বশেষ সভায় প্রাথমিকভাবে রাজধানীর আবাসিক এলাকার ছয় হাজার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণের সিদ্ধান্ত হয়। মন্ত্রিসভার বেঁধে দেওয়া সময়সীমা পার হলেও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো তাদের কার্যক্রম শুরু রাজউকের ব্যর্থতায় করতে পারেনি। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় সরকার সচিবের নেতৃত্বাধীন কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণে প্রথমে ট্রেড লাইসেন্স বাতিলের জন্য চিঠি দেওয়ার কথা দুই সিটি করপোরেশনের। একই সঙ্গে রাজউককেও নোটিস দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর ধাপে ধাপে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও টেলিফোন সেবা কর্তৃপক্ষ চিঠি দিয়ে তাদের সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করবে। কিন্তু বৈঠকের এসব সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়নি। এ ব্যাপারে নগরবিদ মোবাশ্বের হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজউক আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অপসারণে ব্যর্থ হয়েছে। রাজউক একটি নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে আইন প্রয়োগ করাই এই সংস্থার মূল কাজ। কিন্তু স্বার্থের সংঘাতের কারণে রাজউক আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরাতে পারছে না। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে রাজউক যদি সঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করত তাহলে আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক স্থাপনার অপসারণ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হতো না। গুলশান হামলার পর মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তে রাজধানীর ১৬০০ অনাবাসিক স্থাপনার তালিকা তৈরি করে রাজউক। এর মধ্যে গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি ও বারিধারার ৫০২৯টি বাণিজ্যিক স্থাপনা রয়েছে। কিন্তু রাজউকের লোক দেখানো উচ্ছেদ অভিযান কয়েকদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আবারও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো রমরমা বাণিজ্য ফেঁদে বসেছে। বেশ কিছু নামি হোটেল ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানালেন, প্রতিষ্ঠান বন্ধ বা সরানোর কোনো নোটিসই তারা পাননি।

১৬২৫ অবৈধ বাণিজ্যিক স্থাপনা : গুলশান, বনানী ও বারিধারাসহ রাজধানীর আবাসিক এলাকাগুলোতে অনুমোদন ছাড়া গড়ে ওঠা ১৬২৫টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। জোন-২ (উত্তরা) এ ২১৫টি, জোন-৩ (মিরপুর)-এ ৫৮০টি, জোন-৪ (গুলশান, বারিধারা) এ ৫৫২টি, জোন-৫ (ধানমন্ডি ও লালবাগ)-এ ১৭৩টি ও জোন- ৬ (মতিঝিল, খিলগাঁও) এ ১০৫টি অননুমোদিত বাণিজ্যিক স্থাপনা রয়েছে। এসব স্থাপনার মধ্যে ২৬৯টি প্রতিষ্ঠানকে নোটিস দেওয়া হয়েছে। তবে এ প্রতিষ্ঠানগুলো অপসারণের পরিবর্তে রাজউক অভিযান চালিয়ে মোটা অঙ্কের জরিমানা আদায় করেছে। ডিএনসিসি সূত্র জানায়, চলতি বছরের শুরুর দিকে রাজধানীর আবাসিক এলাকাগুলোতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক ভবনগুলোর তালিকা তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আবাসিক এলাকায় বিভিন্ন ধরনের ৬ হাজার ৫৬টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেছে। দক্ষিণে ৭১৫টি এবং উত্তরে ৫ হাজার ৩৪১টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আবাসিক এলাকায় থাকলেও ৪৫৯টি প্রতিষ্ঠান রাজউকের কাছ থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুমোদন নিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছে। বাকি ৪ হাজার ৮৮২টি প্রতিষ্ঠান উত্তর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় বেআইনিভাবে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে ১ নম্বর জোন উত্তরা আবাসিক এলাকায় ৯৩৫টি, ২ নম্বর জোন মিরপুর (১) এ ৯১৯, ৩ নম্বর জোন গুলশানে ৮৩০, ৪ নম্বর জোন মিরপুর (২) এ ৬৭৩ এবং ৫ নম্বর জোন কাওরান বাজারের আবাসিক এলাকায় ১ হাজার ৫২৫টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীর গুলশানে উত্তর সিটি করপোরেশন আয়োজিত আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক ব্যবসা পরিচালনা বিষয়ে করণীয় শীর্ষক আলোচনা সভায় উত্তর সিটি মেয়র আনিসুল হক বলেন, রাজউকের উদাসীনতায় রাজধানীর আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ অবৈধ কাজের মাশুল আমরা দিচ্ছি। এক পরিসংখ্যান তুলে ধরে মেয়র বলেন, ডিএনসিসির বিরাট আবাসিক এলাকায় অননুমোদিত বাণিজ্যিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৪ হাজার ৬৯৪টি। আর ডিএসসিসিতে এ সংখ্যা ১০৯টি। এভাবে দুই সিটি করপোরেশনের আবাসিক এলাকাগুলোতে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান  অবৈধভাবে ব্যবসা চালাচ্ছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে যানজটসহ নানা নাগরিক সমস্যার উদ্ভবের কারণ এসব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। তিনি বলেন, আবাসিক এলাকার এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ৯০ শতাংশেরই পার্কিংয়ের জায়গা নেই। আমরা পার্কিং আর বর্জ্য ব্যবস্থা নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছি।

কূটনৈতিক জোনেই ৮৩০টি অবৈধ প্রতিষ্ঠান : কূটনৈতিক জোন গুলশান-বনানী-বারিধারার আবাসিক এলাকায় বেআইনিভাবে গড়ে উঠেছে ৮৩০টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ৭৭টি নামিদামি রেস্টুরেন্ট, হোটেল, বার ও ফাস্টফুডের দোকান রয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অনুসন্ধানে এই তথ্য উঠে আসে। তবে সিটি করপোরেশনের এই সংখ্যার সঙ্গে দ্বিমত রয়েছে রাজউকের। রাজউকের হিসাবে সিটি করপোরেশনের তালিকার বাইরেও আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সঠিক সংখ্যা জানতে অনুসন্ধান চালাচ্ছে রাজউক। সূত্র জানায়, রাজউকের ৮টি জোনের মধ্যে গুলশান জোনে গুলশান এভিনিউর শুটিং ক্লাব থেকে গুলশান-২ এর গোলচত্বর, মাদানি ও কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর গুলশান-বনানী ব্রিজ থেকে গুলশান-বারিধারা ব্রিজ পর্যন্ত, বনানী-১১ নম্বর রোড এবং গুলশানের সঙ্গে তেজগাঁও সংযোগ সড়কের কিছু অংশ বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের অনুমোদন রয়েছে। কূটনৈতিক জোন গুলশান-বনানী-বারিধারার বাকি অংশ আবাসিক এলাকা। কিন্তু ওই বাণিজ্যিক এলাকাগুলোর চেয়ে গুলশান জোনের আবাসিক এলাকায়ই এখন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি। ডিএনসিসির হিসাবে ৩ নম্বর জোন গুলশান, বনানী, বারিধারা, খিলগাঁও এবং মালিবাগের আবাসিক এলাকায় ৮৩০টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে রেস্টুরেন্ট, হোটেল, বার ও ফাস্টফুডের দোকান রয়েছে ১০৫টি। খিলগাঁও এবং মালিবাগের ৮টি প্রতিষ্ঠান বাদ দিলে বাকি ৯৭টি প্রতিষ্ঠানই রাজধানীর কূটনৈতিক জোন গুলশান-বনানী-বারিধারায়। এর মধ্যে রাজউকের অনুমোদিত বাণিজ্যিক এলাকায় রয়েছে মাত্র ২০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বাকি ৭৭টি নামিদামি দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানই গুলশান-বনানী-বারিধারার আবাসিক এলাকায় অবস্থিত।

কালো তালিকার ১০ হাজার ভবন! রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে রাজধানীতে গড়ে ওঠা অন্তত ১০ হাজার বহুতল ভবনকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের বিশেষ অনুসন্ধান টিম। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও রাজউকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অসহযোগিতা এবং কারসাজির কারণে দুদক টিম মাঠ পর্যায়ে অভিযান চালাতেও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

 

সর্বশেষ খবর