শনিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন

আমেজ জাতীয় নির্বাচনের

সরাসরি পর্যবেক্ষণে দুই নেত্রী

মাহমুদ আজহার, গোলাম রাব্বানী ও রফিকুল ইসলাম রনি, নারায়ণগঞ্জ থেকে ফিরে

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আমেজ এখন নারায়ণগঞ্জে। মহানগরের প্রতিটি অলিগলি, পাড়া-মহল্লায় বইছে নির্বাচনী উত্তাপ। চায়ের টেবিলের আলোচনার ইস্যু নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন (নাসিক)। নগরজুড়েই নৌকা ও ধানের শীষের পোস্টারে সয়লাব। ভোটারদের কাছেও ঘুরেফিরে জাতীয় ইস্যুগুলোই গুরুত্ব পাচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এ নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দুই দলই এ নির্বাচনকে নিয়েছে ‘এসিড টেস্ট’ হিসেবে। খোদ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সরাসরি নাসিক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছেন। জানা যায়, দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে এ নিয়ে নিয়মিত কথা বলছেন দুই নেত্রী। হাইকমান্ডের নির্দেশে কেন্দ্রীয় নেতাদের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি টিমে বিভক্ত করে পাঠাচ্ছেন নারায়ণগঞ্জে। আওয়ামী লীগ তুলে ধরছে বিগত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে বিএনপির আন্দোলনে জ্বালাও-পোড়াওসহ নানা নেতিবাচক কর্মকাণ্ড। অন্যদিকে বিএনপি নেতারা সরকারের অনিয়ম, দুর্নীতি-দুঃশাসন, গণতন্ত্রহীনতাসহ নানা কার্যক্রম তুলে ধরে ভোটারদের কাছে ধানের শীষ প্রতীকে ভোট চাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘২০১৩ সালে একসঙ্গে পাঁচ সিটি নির্বাচনেও জাতীয় ইস্যুগুলো প্রাধান্য পেয়েছিল। একইভাবে নারায়ণগঞ্জেও জাতীয় নির্বাচনের আবহ সৃষ্টি হয়েছে। ভোটাররাও জাতীয় ইস্যুগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। তারা গত সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার আক্ষেপ থেকেই স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচনকে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন।’ নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি খালেদ হায়দার খান কাজল বলেন, ‘এর আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয় ছিল। এখন এ নির্বাচনে জাতীয় প্রতীক আসায় সবার মধ্যে দলীয় আদর্শ প্রাধান্য পাচ্ছে। ভাই ভাইয়ের মধ্যেও নিজ নিজ দলকে সমর্থন করছে।’ গতকাল সরেজমিনে শহরের কালিবাজার, আমলাপাড়া, ২ নম্বর রেলগেট, উকিলপাড়া, চাষাঢ়া শহীদ মিনার, ডিআইটিসহ বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় ভোটারদের সঙ্গে কথা বলেও একই চিত্র পাওয়া গেছে। ভোটারদের অনেকেই বলছেন, বিগত সময়ে আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াওয়ের জবাব দেওয়া হবে নাসিক নির্বাচনে। নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে তারা আবারও উন্নয়নের পক্ষের শক্তিকে ক্ষমতায় আনবেন। অন্যদিকে ভোটারদের বড় একটি অংশ এও বলছেন, বিগত জাতীয় সংসদসহ পরবর্তীতে কোনো নির্বাচনেই আমরা ভোট দিতে পারিনি। এবার সুযোগ পেলে উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে। ১২ নম্বর ওয়ার্ডে ইসদাইর বাজার এলাকার ভোটার সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘অবশ্যই আমরা উন্নয়নের কথা বিবেচনায় নৌকা প্রতীকে ভোট দেব। আমাদের বাজার এলাকার রাস্তাঘাট কয়েক দফা উন্নয়ন করা হয়েছে। বিএনপির আমলে ছিল অবহেলিত। আর মানুষ জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতি এখন বিশ্বাস করে না।’ ২ নম্বর ওয়ার্ডের মিজমিজি দক্ষিণপাড়া এলাকার ভোটার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর ধানের শীষ প্রতীকে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছি। এই সরকারের আমলে মানুষ ভোট দেওয়ার অধিকার পায়নি। এখনো আমরা আশঙ্কায় আছি। তবে সুষ্ঠু ভোট হলে ধানের শীষের প্রার্থী বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন।’ নাসিক নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্যতম সমন্বয়ক আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান বলেন, ‘অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার ও নির্বাচন কমিশন প্রমাণ করবে আগামী জাতীয় নির্বাচনও অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। এ নির্বাচন শুধু সিটি করপোরেশন এলাকাই নয়, দেশে নির্বাচনী আমেজ বিরাজ করছে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী জয়লাভ করবেন। সব ভেদাভেদ ভুলে নির্বাচনে দলীয় নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নেমে পড়েছেন। এটা বিজয়ের জন্য ইতিবাচক।’ বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও নাসিকের সিদ্ধিরগঞ্জ থানা সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় ইস্যুগুলো প্রাধান্য পাচ্ছে। বিশেষ করে ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনে সারা দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি। দেশে গণতন্ত্র নেই। আইনের শাসন অনুপস্থিত। মানুষ দুর্বিসহ জীবনযাপন করছে। তাই নাসিকে ভোট দিয়ে জনগণ প্রতিবাদ জানাতে চায়।’

প্রার্থীদের গণসংযোগ : ছুটির দিনে গতকাল দিনভর প্রচারণা চালিয়েছেন মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা। বিভিন্ন মসজিদেও প্রার্থীদের জন্য বিশেষ দোয়া চাওয়া হয়েছে। মসজিদের সামনে লিফলেট বিতরণ করতে দেখা গেছে কাউন্সিলর প্রার্থীদের। সকাল ৯টা থেকে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ১০ নম্বর ওয়ার্ডের গোদনাইল ইবরাহিম টেক্সটাইল মিল, মীরপাড়া, গোদনাইল বাজার, নিউ লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিল, আরামবাগ, চিত্তরঞ্জন, রসুলবাগ, পাঠানটুলী রেললাইন এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করেন এবং নৌকায় ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান। বিকালে শহরের চাঁদমারি এলাকায় প্রচারণা চালান আইভী। নৌকা প্রতীকের পক্ষে প্রচারে অংশ নেন সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী ও যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুল হাই, সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত মো. শহীদ বাদল, মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি আনোয়ার হোসেন, সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা, সাংগঠনিক সম্পাদক জি এম আরমান, এস এম পারভেজ প্রমুখ। এদিকে সকালে সিটি করপোরেশনের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে গণসংযোগ করেন ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান। দুপুর পর্যন্ত ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড়, লন্ডন মার্কেট, নিমাইকাশারী, বাঘমারা, মাদানীনগর, নয়াআটি মুক্তিনগর ও রসুলবাগ এলাকায় গিয়ে গণসংযোগ শেষ করা হয়। ১ নম্বর ওয়ার্ডের সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি বাতেনপাড়া এলাকায় সাখাওয়াতের পক্ষে গণসংযোগ চালানো হয়। নগরীতে তিন ভাগে কেন্দ্রীয় নেতারা প্রচারণা চালাচ্ছেন। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বিকালে নাসিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তিন থানায় আসা কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, আতাউর রহমান ঢালী, জয়নুল আবদিন ফারুক, অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ, আ ক ন কুদ্দুসুর রহমান, অধ্যক্ষ সেলিম ভূইয়া, আফরোজা আব্বাস, সুলতানা আহমেদ, ডা. রফিকুল ইসলাম বাচ্চু, মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, শফিকুল ইসলাম রাসেল, অধ্যাপক মামুন মাহমুদসহ জাতীয় ও স্থানীয় নেতারা বিভিন্ন এলাকায় প্রচারে অংশ নেন।

১ নম্বর ওয়ার্ডে প্রচারণা চালান হাতপাখা প্রতীকে ইসলামী আন্দোলনের মেয়র প্রার্থী মুফতি মাসুম বিল্লাহ। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির কোদাল প্রতীকে মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান ইসমাইল নগরীর সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইল, বন্দরের ফারাজীকান্দা ও মদনগঞ্জ এলাকায় গণসংযোগ চালান।

ইসির লিফলেট বিতরণ : ভোটারদের সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে সিদ্ধিরগঞ্জে লিফলেট বিতরণ করেছেন নাসিক নির্বাচনে নিয়োজিত রিটার্নিং অফিসার নুরুজ্জামান তালুকদার। গতকাল দুপুরে সিদ্ধিরগঞ্জের চৌধুরীবাড়ী ও চিটাগং রোড হাজী ইব্রাহীম খলিল শপিং কমপ্লেক্স এলাকায় এ লিফলেট বিতরণ করা হয়। পরে তারা বন্দরের মদনপুর, ইস্পাহানি, ধামঘর, মদনগঞ্জ ও নবীগঞ্জ এলাকায়ও এ প্রচারপত্র বিলি করেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন সহকারী রিটার্নিং অফিসার তারিফুজ্জামানসহ নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা। ভোটারদের ভোটাধিকার নির্বিঘ্ন করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকবে বলে উল্লেখ করা হয় লিফলেটে। এতে আরও উল্লেখ করা হয়, ভোটের দিন সাংসারিক কাজ কমিয়ে মহিলা ভোটারদের স্বাচ্ছন্দ্যে ভোট প্রদান করতে দিন। ইসির লিফলেটে বলা হয়, ভোটের আগে কোনো মিছিল, শোডাউন বা শোভাযাত্রা করা যাবে না।

পোস্টারে সয়লাব নাসিক : ২২ ডিসেম্বর সিটি নির্বাচন কেন্দ্র করে শহরের প্রতিটি অলিগলি, পাড়া-মহল্লায় শুধুই পোস্টার আর পোস্টার। প্লাস্টিকের কাগজে মোড়ানো (ল্যামিনেটিং) পোস্টারে ছেয়ে গেছে বন্দরনগরী। প্রার্থীদের হাতে নানা প্রতিশ্রুতিসংবলিত লিফলেট। ভোটারদের দিচ্ছেন নানা উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি। এ ছাড়া মাইকে ভোটারদের মন জয় করতে প্রার্থীদের নিয়ে নানা ধরনের গান পরিবেশন করা হচ্ছে। জুমার নামাজ পড়ে বের হলেই মুসল্লিদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে লিফলেট। শহরের প্রধানতম বঙ্গবন্ধু সড়কের চাষাঢ়া থেকে নিতাইগঞ্জ পর্যন্ত পুরো সড়কেই বিভিন্ন প্রার্থীর ছবি ও প্রতীকসংবলিত পোস্টার টানানো হয়েছে। নির্বাচনের আচরণবিধি অনুযায়ী পোস্টার প্লাস্টিকের ভিতরে টানাতে হবে। পোস্টার কোনো দেয়ালে সাঁটানো যাবে না। ফলে সড়কের ওপরই দড়ি দিয়ে বেঁধে টানানো হচ্ছে পোস্টার। শুধু প্রধান সড়ক নয়, পাড়া-মহল্লায়ও ছেয়ে গেছে পোস্টার। অনেক স্থানে আছে ফেস্টুনও। এ প্রসঙ্গে রিটার্নিং অফিসার নুরুজ্জামান তালুকদার বলেন, ‘পোস্টার ছাপানোর একটি নির্দিষ্ট আকৃতি আছে। পোস্টার কীভাবে টানাবে, কী রং হবে সেসব আচরণবিধি মানতে হবে প্রার্থীদের। কেউ না মানলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর