রবিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

সংসদ ইচ্ছা করলেই সংবিধানের মূল স্তম্ভ বদলাতে পারে না

নিজস্ব প্রতিবেদক

সংসদ ইচ্ছা করলেই সংবিধানের মূল স্তম্ভ বদলাতে পারে না

এস কে সিনহা

জাতীয় সংসদ চাইলেই অনেক কিছু পরিবর্তন করতে পারে; কিন্তু সংবিধানের মূল স্তম্ভ পরিবর্তন করতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তিনি বলেন, পার্লামেন্টের আইন করার যথেষ্ট ক্ষমতা আছে, পার্লামেন্ট সম্পূর্ণভাবে সংবিধানের সংশোধন করতে পারবে। এমনকি সংবিধানকে বন্ধ করে দিতে পারবে। আজকে যদি সরকার বলে দেয় সুপ্রিমকোর্ট থাকবে না, আমাদের কিছুই করার থাকবে না। পার্লামেন্টের এই ক্ষমতা আছে। কিন্তু সংসদ ইচ্ছে করলেইপার্লামেন্টের এই ক্ষমতা নেই যে, মেইন পিলারস অব দ্য কনস্টিটিউশন। সংবিধানের মেইন পিলার যেটি আমরা পঞ্চম সংশোধনী, ষষ্ঠ সংশোধনীসহ সবগুলোতে বাতিল করেছি যে, বেসিক স্ট্রাকচার অব দ্য কনস্টিটিউশন চেঞ্জ করে কোনো সংবিধান বা কোনো আইন করা যাবে না। গতকাল সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতিতে এক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি এ কথা বলেন। নিম্ন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি, বদলি এবং শৃঙ্খলামূলক কার্যক্রম সম্পর্কিত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের ১১৬ এবং ১১৬(এ) সংবিধানের প্রিন্সিপালসের সঙ্গে কনফ্লিক্ট করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে এই দুই বিধান সংবিধানের পরিপন্থী। যা আমাদের পবিত্র বই থেকে অতি তাড়াতাড়ি সরিয়ে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। এটি থাকায় আমাদের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এর আগে অক্টোবরে এক বাণীতে এই অনুচ্ছেদটিকেই বিচার বিভাগের ধীরগতির অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেন প্রধান বিচারপতি। আইন পেশায় বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল বাসেত মজুমদারের ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আইনজীবী সমিতির সভাপতি ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির হোসেন, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, খন্দকার মাহবুব হোসেন, জয়নুল আবেদীন ও মাহবুব উদ্দিন খোকন। এ ছাড়াও সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিসহ আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে আবদুল বাসেত মজুমদারকে দেশের বিভিন্ন আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়। নিজের বক্তব্যে বাসেত মজুমদার সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, ১৯৬৬ সালে হাইকোর্টে আইন পেশা শুরু করি। প্রথম দিকে অনেক দুঃখ দুর্দশায় জীবন কাটালেও পরে তা কাটিয়ে উঠি। নিজেকে গরিবের আইনজীবী উল্লেখ করে তিনি বলেন, সব সময়ই দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। প্রধান বিচারপতি বলেন, আমি কোনো এক অনুষ্ঠানে বলেছিলাম এদেশে দ্বৈত শাসন চলছে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আইনমন্ত্রী বললেন যে, চলে না। প্রধান বিচারপতি আইনের অভিভাবক। সংবিধানের অভিভাবক হয়ে বলছি, যদি এটি না হয়, তাহলে আজকে আমরা বিচারকদের ডিসিপ্লিন রুলস কে করবেন? সরকার করবে না আমরা বিচারকরা করব? তাদের কন্ট্রোল, বদলি কোনো কিছুই আমরা করতে পারছি না। তাই এ অসাংবিধানিক প্রভিশনগুলো তাড়াতাড়ি সরিয়ে দেওয়া হবে বলে আমি আশা করি। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, বলা হচ্ছে, আমাদের ফান্ডামেন্টাল রাইটস খর্ব করা হচ্ছে। আমরা সুপ্রিমকোর্ট কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব করি না। আপনারা যারা আইনজীবী আছেন, তারাও কোনো দলের প্রতিনিধিত্ব করেন না। আপনারা যখন আইনের শাসনের কথা বলেন, ফান্ডামেন্টাল রাইটসের কথা বলেন, আপনারা যখন জনগণের কথা বলেন, আমি বলব, আপনাদেরও কিছু দায়িত্ব আছে। দেশের প্রতি সরকারের প্রতি কিছু দায়িত্ব আছে। প্রধান বিচারপতি বলেন, আইন পেশা সম্মানের পেশা। ক্রিম অব দ্য সোসাইটি দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটি অংশ চলে যায় আইন পেশায়, একটি ক্ষুদ্র অংশ বিচার বিভাগে চলে যায়। তারা দুই ভাগে বিভক্ত হলেও প্রত্যেকের উদ্দেশ্য হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। সে অর্থে আমরা একই পরিবারের সদস্য। আইনজীবীরা জাতির বিবেক। বিচারকরাও জাতির বিবেক। কিন্তু তাদের পক্ষে কোড অব কন্ডাক্টের কারণে পাবলিকলি কথা বলতে পারেন না। তিনি আরও বলেন, যখনই সংবিধানকে লাইনচ্যুত করে বাঁকাপথে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, তখনই সুপ্রিমকোর্ট এটিকে সোজা করে দিয়েছে। পবিত্র সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত হওয়া থেকে সুপ্রিমকোর্ট সব সময়ই রক্ষা করেছে। আইনজীবীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আইনজীবীদের প্রাথমিক জীবন অনেক সময় কষ্টের এবং দুর্দশাগ্রস্ত হয়। তবে টাকার জন্য না দৌড়ে যোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। তিনি বলেন, এই সংবিধান একটি সোশ্যাল ডকুমেন্ট। এই সংবিধানে বলা আছে, আমাদের বঙ্গবন্ধু প্রথমেই বলেছেন, এই দেশে এমন একটা সংবিধান হবে, যেখানে কমপ্লিট জাস্টিস থাকবে, রুল অব ল’ মেনটেইন করা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সংবিধানের সঙ্গে তুলনা করা যায়। আমরা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, আমাদের সংবিধান এ রকমই ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা দেখলাম, এই সংবিধান ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। এই সংবিধানে মৌলিক অধিকার রক্ষিত করা হয়েছে। এই সংবিধানে রক্ষিত করা আছে, যারা সমাজে অনুন্নত তাদেরকেও। সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদ প্রটেকশন করে দিয়েছে, জুডিশিয়াল রিভিউয়ের জন্য যে কেউ আসতে পারবেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা সংবিধানের অসাংবিধানিক প্রভিশনগুলো বাতিল করেছি। কিন্তু আমরা এখনো দেখতে পাচ্ছি, বর্তমানে সংবিধানে যে ১১৬ ধারা এবং ১১৬ (এ), সেগুলোকে যথাক্রমে চতুর্থ এবং পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১১৬ এবং ১১৬ (এ) সন্নিবেশন করা হয়েছে। এ দুই বিধান থাকার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু যে ১১৬ রাখার বিধান করেছিলেন, ইনডিপেনডেন্ট অব জুডিশিয়ারি এবং রুল অব ল’ বলতে আইনের শাসন বলতে কি রকম করতে হবে, সেটিকে আমরা বাদ দিয়ে দিয়েছি। আমরা পঞ্চম সংশোধনী, সপ্তম সংশোধনী, ত্রয়োদশ সংশোধনী প্রত্যেকটি সংশোধনীতে বাতিল করেছি।

 

সর্বশেষ খবর