সোমবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

গোপন তৎপরতায় হুজিবি

সংগঠিত হচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রামে। বড় হামলার টার্গেট

সাখাওয়াত কাওসার ও মুহাম্মদ সেলিম

দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকলেও ফের সংগঠিত হচ্ছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি)। সক্রিয় হচ্ছে নব উদ্যমে। বিদেশে পলাতক সদস্যরা গোপনে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন অর্থ। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে গোপনে কর্মী সংগ্রহ এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। আপাতত কারাবন্দী হুজিবির শীর্ষ নেতাদের মুক্ত করা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর স্থাপনায় হামলা করে অস্ত্র লুটসহ রয়েছে কয়েকটি বড় ধরনের হামলার টার্গেট। দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জঙ্গিদের সংগঠনে ফের সক্রিয় হওয়ার খররে রীতিমতো নড়ে চড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

গোয়েন্দা সূত্র বলছে, সম্প্রতি সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে হত্যাচেষ্টা মামলার রায় হওয়ায় হুজিবি সদস্যরা নতুন করে তাদের অবস্থান জানান দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। তবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা জেএমবি, নতুনধারার জেএমবি, একিউআইএস নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করার সুযোগ নিচ্ছে হুজিবি। গোপনে সেরে নিচ্ছে তাদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড। বিদেশে পলাতক থাকা হুজিবির শীর্ষ নেতা মাওলানা আবদুল্লাহ মাসউদ, মাওলানা কাওসার, মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ ওরফে সাগর বিন এমদাদের মতো ৮/১০ জন গোপনে সংগঠনের জন্য অর্থ পাঠাচ্ছেন। এসব অর্থ থেকে কারাবন্দী এবং নিহত হুজি সদস্যদের পরিবারকে নিয়মিতভাবে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। খবর রয়েছে দেশে অবস্থান করা ছদ্মবেশী ব্যবসায়ী নিয়মিতভাবে হুজিবির ফান্ডে অর্থ সহায়তা দিয়ে আসছেন। এর বাইরে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নামে বিদেশে থাকা হুজিবি সদস্যরা অর্থ সহায়তা পাঠাচ্ছেন। ওই সংগঠন থেকে হুজিবির সদস্যদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে সাহায্য। পলাতক হুজিবি সদস্যদের ছবিসহ প্রয়োজনীয় তথ্য দেশের সবকটি বিমানবন্দর, স্থলবন্দর এবং সমুদ্রবন্দরে দেওয়া হয়েছে। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ বলেন, হুজিবির সদস্যরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে এমন খবর আমাদের কাছে আছে। তবে র‌্যাব সদস্যরা এ বিষয়ে তত্পর। যে কোনো ধরনের নাশকতা কিংবা হামলার চেষ্টা রুখে দেওয়ার সামর্থ্য র‌্যাবের আছে। সূত্র বলছে, দেশে সশস্ত্র জেহাদের লক্ষ্যে তিন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে হুজি। তিন নামের এই গ্রুপগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনজন। যার মধ্যে ‘হুজি’র নেতৃত্বে রয়েছে মুফতি আবদুস সালাম। ‘হরকাতুল মুজাহিদীন’ গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন মুফতি আবদুল হান্নান এবং ‘তাআমির উদ দীন’ নামে গ্রুপটির নেতৃত্বে রয়েছেন মুফতি আবদুর রউফ। গ্রুপগুলোর মধ্যে হুজি সশস্ত্র জিহাদের পক্ষে না থাকলেও অন্য দুটি গ্রুপ সশস্ত্র জিহাদের বিষয়ে কট্টর হিসেবে পরিচিত। এর মধ্যে নিষিদ্ধ এ জঙ্গি সংগঠন নাম পাল্টে প্রথমে ইসলামী দাওয়াতি কাফেলা, পরে সচেতন ইসলামী জনতা, ইসলামী গণআন্দোলন, সর্বশেষ ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি (আইডিপি) নামে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার চেষ্টা করে। কিন্তু রাজনৈতিক দল গঠনে ব্যর্থ হয়ে ফের জঙ্গি তত্পরতায় সক্রিয় হয় এ সংগঠনের নেতারা। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন এলাকাকে কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করে চলছে হুজির দাওয়াতি, আসকারি ও জিহাদি কার্যক্রম। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে হুজির হাজারের অধিক সক্রিয় জঙ্গি সদস্য। সূত্র বলছে, বিগত সময়ে বিভিন্ন অপারেশনে হুজির যেসব সদস্য আহত কিংবা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারকে বর্তমানে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে। যেসব নেতা মারা গেছেন তাদের স্ত্রীকে হুজির কর্মীরা বলে ‘বেওয়াত’। যারা আহত হয়েছেন তাদের বলা হয় ‘মাজুদ’। বর্তমানে বেওয়াত, মাজুদ ও কারাবন্দী নেতা-কর্মীর স্বজনদের সাহায্য করছে হুজি। এসব অর্থ আসে মূলত কাতার, মালয়েশিয়া এবং সৌদিআবর থেকে। হুজির অন্যতম সমন্বয়ক মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ বিদেশে তহবিল সংগ্রহ করে তা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে পাঠানোর বিষয়টা তদারকি করেন। খালেদ সাইফুল্লাহ বর্তমানে দুবাই অবস্থান করছেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মাহমুদা আফরোজ লাকী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গত জুলাই মাসে গ্রেফতার তিন হুজিবির কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমরা পেয়েছিলাম। ওই তথ্য আমাদের অপারেশনে অনেক কাজে দিয়েছে। শিগগিরই হয়তো আরও ভালো খবর দেওয়া যাবে।’ জানা যায়, ১৯৮৮ সালে আফগান ফেরত ৫ হাজার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুজাহিদ নিয়ে বাংলাদেশে শুরু হয় হুজির কার্যক্রম। যাত্রা শুরুর পর থেকে এ জঙ্গি সংগঠনের নেতৃত্ব দেন আবদুর রহমান ফারুকী, মঞ্জুর হাসান, মুফতি আবদুল হাই, কমান্ডার মঞ্জুর আহম্মদ, মুফতি আবদুস সালাম, মওলানা মঞ্জুর হাসান, কমান্ডার বাসেদ ও মুফতি শহীদুল ইসলাম এবং মুফতি হান্নান। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের পথসভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা, রমনার বটমূলে বোমা হামলা, ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত আনোয়ার চৌধুরীর ওপর বোমা হামলা, কবি শামসুর রাহমানের ওপর হামলাসহ বেশকিছু হামলার নেপথ্যে ছিল হুজি। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর অভিযানের মুখে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে তাদের কার্যক্রম। সাম্প্রতিক সময়ে অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর উত্থানের পর ফের চাঙ্গা হতে থাকে হুজি। সম্প্রতি চট্টগ্রামের আকবর শাহ এলাকার আস্তানা থেকে গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে র‌্যাব-৭ অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, হুজিবির সদস্যরা বিভিন্ন স্থাপনাকে টাগের্ট করে হামলার পরিকল্পনাও করছিল। এ জন্য চট্টগ্রামে জড়ো হয়। কিন্তু র‌্যাব অভিযান চালিয়ে পাঁচজনকে গ্রেফতারের পর নস্যাৎ হয় তাদের সেই পরিকল্পনা। তাদের নেটওয়ার্ককে ধ্বংস করতে কাজ করছে র‌্যাব।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর