সোমবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

অনিয়মের শেষ নেই বন্ডেড ওয়্যার হাউসে

রুহুল আমিন রাসেল

শুল্কমুক্ত সুবিধার আড়ালে বন্ডেড ওয়্যার হাউসে হাউসগুলো সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বন্ডেড হাউসগুলোর অনিয়মের শেষ নেই। পুনঃরপ্তানির শর্তে আমদানি করা পণ্য ফ্রিস্টাইলে বিক্রি হচ্ছে খোলাবাজারে, তাও দেখার কেউ নেই। এই সুবিধায় সরকার প্রতিবছর প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা শুল্ক অব্যাহতি দিলেও, সেই শুল্কের টাকা লুটপাটে ব্যস্ত অসাধু ব্যবসায়ীরা। এমন প্রেক্ষাপটে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারী ১৩৩টি প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে। অনিয়মের কারণে চলতি বছর পর্যন্ত ১৭৬০ প্রতিষ্ঠানের বন্ড লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, ফ্রিস্টাইলে দেওয়া হচ্ছে বন্ড লাইসেন্স। ফলে ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে শত শত বন্ড লাইসেন্স রয়েছে। এসব বন্ড লাইসেন্স দিয়ে আমদানি করা পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পুকুর চুরি করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের ওয়েবসাইটে পাওয়া সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী— দেশে এখন ৬ হাজার ২৭০টি প্রতিষ্ঠানের বন্ড লাইসেন্স থাকলেও, সক্রিয় কারখানা আছে ৩ হাজার ৮৩২টি। বাকি ২ হাজার ৪৩৮টি কারখানা চালু নেই, তবে তাদের বন্ড লাইসেন্স আছে। বন্ধ থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ড লাইসেন্স দিয়ে কী করছে, তা কেউ জেনেও জানে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড—এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বন্ডের অপব্যবহার আমাদের জন্য ক্ষতিকর। এটা বন্ধ করতে চাই। এ জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ নিচ্ছি। এ ছাড়াও বন্ডকে অটোমেশনের আওতায় আনা হচ্ছে। এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বন্ড সুবিধার আড়ালে যে সব অপকর্ম হয় বা হচ্ছে তা বন্ধে দ্রুত অটোমেশন পদ্ধতি চালু করাই একমাত্র পথ। এনবিআর অনেক তত্পর। আশার কথা, এ ধরনের ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত করে ধরাও হচ্ছে। আমি বলব— জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পাচার করা অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নিতে হবে। ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের তথ্যমতে, রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানাগুলো পুনঃরপ্তানির শর্তে শুল্কমুক্ত বন্ড সুবিধায় পণ্য আমদানির সুযোগ পায়। বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধার আওতায় রপ্তানির নামে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি হয়েছে দিনের পর দিন। ফলে প্রতিবছর শুধু আমদানি পর্যায়ে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি শুল্ক কর অব্যাহতি দিয়ে থাকে সরকার। স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) অব্যাহতির হিসাব বিবেচনায় নেওয়া হলে এর পরিমাণ আরও অনেক বেশি হবে। বন্ড সুবিধার অপব্যবহার প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ‘পোশাক খাতের ইউডি (ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন) ইস্যুর ক্ষমতা ১৯৯৩ সাল থেকে বিজিএমইএকে দেওয়া হয়েছে। একজন পোশাক মালিক এক লাখ পিস শার্ট রপ্তানির অর্ডার পাওয়ার পর তিনি যখন ইউডি নেন, তখন প্রতি পিসে হয়তো আড়াই গজ ফেব্রিক্স হিসাব করে বন্ড সুবিধায় আড়াই লাখ গজ কাপড় আমদানি করেন। কিন্তু আদতে দেখা গেল, তার প্রতিটি শার্ট তৈরিতে ফেব্রিক্স লেগেছে দুই গজ করে। এতে দুই লাখ গজের ফেব্রিক্স দিয়ে শার্ট বানিয়ে রপ্তানি করল, বাকি ৫০ হাজার গজ কাপড় খোলা বাজারে বিক্রি করে দিল।’ দেশে পণ্য আমদানিতে শুল্কমুক্ত বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধার অপব্যবহার করে শুল্কফাঁকি দিতে পাঁচ কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন অসৎ ব্যবসায়ীরা। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী যে পাঁচ কৌশলে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার হচ্ছে, সেগুলো হলো— বন্ড লাইসেন্সে পণ্যের প্রাপ্যতা সঠিকভাবে নির্ধারণ না করা। ডেডো কর্তৃক সঠিকভাবে সহগ নিরূপণ ও নির্দিষ্ট সময় পর পর তা হালনাগাদ না করা। বন্ডে আমদানির তথ্য পাস বইতে যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ না করা। ভ্যাট বিভাগের কর্মকর্তারা শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সঠিকভাবে মনিটরিং না করা। কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট কর্তৃক বন্ডেড লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে যথাযথভাবে অডিট না করা। এ ধরনের বন্ড লাইসেন্সের অপব্যবহারকারী ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের তালিকা করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছে এনবিআর। এনবিআরের তথ্যে দেখা গেছে, দেশে এখন ব্যাক টু ব্যাক এলসি বা ঋণপত্র ছাড়া বন্ডের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণে পণ্য আমদানি হচ্ছে। ব্যাক টু ব্যাক এলসি ছাড়া পণ্য আমদানির আইনগত সুযোগ থাকলেও, এই সুযোগের ব্যাপক অপব্যবহার হচ্ছে। যেমন পিভিসি রেসিন ও ইভা নামীয় পণ্যগুলো ব্যাপক হারে আমদানি করা হলেও বন্ড প্রতিষ্ঠানে এর ব্যবহার নেই। যদিও বন্ড লাইসেন্স প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরেজমিনে যাচাই করে প্রাপ্যতা নির্ধারণ এবং কোন প্রতিষ্ঠানে কোন পণ্য কী কাজে প্রয়োজন সে বিষয়টি নির্ধারণ করে দেয়— শুল্ক রেয়াত ও প্রত্যর্পণ পরিদফতর-ডেডো। এর আগে শুল্কমুক্ত আমদানিতে বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধা প্রাপ্ত রপ্তানিমুখী শিল্প-কারখানার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট গতবছর ২০১৫ সালে বন্ড লাইসেন্সধারী এক হাজার ১২৮টি প্রতিষ্ঠানে অনিয়মের এই তথ্য উদঘাটন করেছে। জানা গেছে, রপ্তানির শর্তে আমদানি করা শুল্কমুক্ত সুবিধার পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করে রাজস্ব ফাঁকি, আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা, কম দামে কেনা পণ্যের বেশি মূল্য দেখানো, আবার বেশি দামে বিক্রি করা পণ্যের দাম কাগজপত্রে কম দেখানোর মতো প্রক্রিয়াতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো এক হাজার ৬৫১ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) গত ৮ ডিসেম্বর প্রকাশিত অর্থ পাচারের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলেছে, বিগত ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার বা ৭৬ হাজার ৩৬১ কোটি ৪০ লাখ টাকা পাচার হয়েছে। যা আগের বছর ২০১২ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের ৩৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ থেকে ২০১২ সালে ১৭৮ কোটি ডলার বা তখনকার মুদ্রা বিনিময় হারে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এর আগের বছর ২০১১ সালে পাচার হয়েছিল ৫৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার বা ৪ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। মাত্র ৩ বছরের ব্যবধানে দেশ থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে অর্থ পাচারের হার। জিএফআই উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে অবৈধ অর্থের প্রবাহ ২০০৪-১৩ শীর্ষক এবারের প্রতিবেদন-২০১৫-তে বলেছে, মূলত আমদানি-রপ্তানির সময়ে পণ্যের প্রকৃত মূল্য গোপন করার মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার করা হয়েছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ৭৬ হাজার কোটি টাকা পাচার হলেও সব মিলিয়ে বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের পরিমাণ ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। বিগত এক দশকের বিবেচনায় বাংলাদেশ অর্থ পাচারের তালিকায় ২০১৪ সালে ৫১ নম্বরে ছিল। কিন্তু অর্থ পাচারের এই হার কয়েকগুণ বাড়ায় জিএফআইর প্রতিবেদন-২০১৫-এ বাংলাদেশের অবস্থান ২৬তম।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর