বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

হদিস মেলেনি নিখোঁজ সাত যুবকের

সাখাওয়াত কাওসার

এখনো হদিস মেলেনি নিখোঁজ সাত যুবকের। তারা কী করছে, প্রকৃত অবস্থানই বা কোথায়—এ বিষয়ে কোনো তথ্যও বের করতে পারেনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। নিখোঁজ ব্যক্তিরা দেশ ছেড়েছে—এমন তথ্যও নেই তাদের কাছে। ১৩ দিন আগে ঢাকা, পাবনা, রংপুর ও বরিশাল থেকে নয়জন যুবক নিখোঁজ হয়েছিলেন। এর মধ্যে বরিশাল ও রংপুর থেকে নিখোঁজ দুই যুবকের সন্ধান পাওয়া গেছে। বাকি সাতজনের বিষয়ে র‌্যাব-পুলিশ দাবি করছে, তাদের জীবনাচরণ বিশ্লেষণ করে নানারকম সংশয় তৈরি হয়েছে। তাদের বন্ধু ও পরিচিতজনদের রাখা হচ্ছে নজরদারিতে। নিখোঁজ যুবকদের মাধ্যমে ধ্বংসাত্মক ঘটনার অবতারণা হতে পারে—এমন আশঙ্কায় রাজধানীর কূটনৈতিক পাড়ায় বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এলিট ফোর্স র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নিখোঁজদের নিয়ে এক ধরনের টেনশন কাজ করে, এটা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। এজন্য সব ধরনের প্রস্তুতি রেখেই তাদের সন্ধান পেতে অভিযান চালানো হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অতীতে অনেক ঘটনার রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে আমরা দেখেছি অনেক ব্যক্তি নিজেরাই আত্মগোপনে ছিলেন। অনেককে অপহরণও করা হয়েছিল। তবে সাত ব্যক্তির সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না। জানা গেছে, গত ১ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানী এলাকা থেকে একযোগে চার তরুণ নিখোঁজ হন। তারা হলেন সাফায়েত হোসেন, জায়েন হোসেন খান পাভেল, সুজন ও মেহেদী। এদের মধ্যে সাফায়েত ও পাভেল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, চারজনের একযোগে নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি রহস্যজনক। নিখোঁজ চারজনের মধ্যে সাফায়েতের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রোফাইল ঘেঁটে জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ার বিষয়ে সন্দেহ করছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। তবে ১৩ দিন পেরিয়ে গেলেও এ বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য জানাতে পারেননি তারা। একযোগে নিখোঁজ চার তরুণের একজন সুজনের ভাই সুমন জানান, সুজন নিখোঁজের পর থেকে পরিবারের সবাই ভেঙে পড়েছেন। সে কোথায় আছে, কীভাবে আছে—আমরা কিছুই জানতে পারছি না। পুলিশও আমাদের কোনো ‘আপডেট’ জানায়নি। বিষয়টি নিয়ে আমাদের পরিবারের সবাই অনেক দুশ্চিন্তায় রয়েছে। ঢাকার কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আবদুুল মান্নান বলেন, নিখোঁজ তরুণদের উদ্ধারে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তারা আত্মগোপনে রয়েছে, নাকি কেউ তাদের তুলে নিয়ে গেছে—এ বিষয়টি না জানার আগ পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করা যাচ্ছে না। ইউনিটের অপর এক কর্মকর্তা জানান, অনেক সময় জঙ্গিদের ভাষায় ফিদায়ি হওয়া বা হিজরত করার আগ পর্যন্ত তারা নিজেদের জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ার বিষয়টি পরিবারের সদস্যদের বুঝতে দেয় না। এ কারণে তারা ধর্মীয় অনুশাসনও যথাযথভাবে পালন করে না। একযোগে চার তরুণ নিখোঁজের ক্ষেত্রে সাফায়েতের মাধ্যমে বাকি তিন তরুণ ‘মোটিভেটেড’ হতে পারে বলে তারা ধারণা করছেন। নিখোঁজ মেহেদীর চাচা মাহবুব হাওলাদার বলেন, ১৩ দিন হয়ে গেল, চারটা ছেলে কোথায় গেল—কেউ খুঁজে বের করতে পারছে না। তারা তো একদিনের মধ্যে দেশ ছেড়ে যায়নি। তাদের পাসপোর্টও নেই। তাহলে কেন খুঁজে বের করা যাচ্ছে না?’ মাহবুব হাওলাদার আরও বলেন, ‘যদি ওরা স্বেচ্ছায় কোনো ভুল পথে গিয়ে থাকে তবুও তো তাদের দ্রুত খুঁজে বের করে আনা উচিত। বের করে এনে আইনি প্রক্রিয়ায় যা করার করবে। এতে পরিবারের সদস্যরাও শান্তি পাবে যে, ছেলে ভুল করেছে তার শাস্তি পাচ্ছে। কিন্তু এসবের কিছুই তো দেখছি না।’ ৫ ডিসেম্বর সাইদ আনোয়ার খান নামে বনানী এলাকার আরেক তরুণ নিখোঁজ হন। ও লেভেল সম্পন্ন করা এই তরুণ কলাবাগানে একটি ক্যারাতে প্রতিযোগিতায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ শেষে আর বাসায় ফেরেনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, নিখোঁজ সাইদের জীবনাচরণে তারা ‘সন্দেহজনক’ কিছু তথ্য পেয়েছেন। এসব সূত্র ধরেই তার অবস্থান জানার চেষ্টা চলছে। সাইদের পরিবারের সদস্যরা জানান, নিখোঁজের পর থেকেই সাঈদের বাবা-মা ভেঙে পড়েছেন। তারা ছেলেকে উদ্ধারের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। কিন্তু ১৩ দিন পেরিয়ে গেলেও সাইদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। সাইদ আনোয়ার খানের মা জেনিফার খান বলেন, যে ছেলে ছোটভাইকে নিয়ে মালয়েশিয়ায় বেড়াতে যাবে বলে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছিল, সেই ছেলে স্বেচ্ছায় বেরিয়ে যেতে পারে না। ওকে কেউ তুলে নিয়ে গেছে বলে সন্দেহ তার। তিনি বলেন, ‘ঘটনার দিন ছেলে ক্যারাতে ক্লাসে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফেরার পথে সে নিখোঁজ হয়েছে। সে যদি স্বেচ্ছায় চলে যেত, তাহলে তার ক্যারাতে ক্লাসে যাবার প্রয়োজন ছিল না। সে এমনিতেই বাসা থেকে বেড়িয়ে চলে যেতে পারত।’ সাইদের মামা ইকরাম কবির বলেন, ‘আমরা নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচ্ছি। কিন্তু তারা কোনো আপডেট দিতে পারছে না।’ পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ৩০ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মাটিকাটার বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হওয়া কেয়ার মেডিকেল কলেজের ছাত্র ইমরান ফরহাদের বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে তার অবস্থান জানার চেষ্টা চলছে। ইমরানের ফুফাতো ভাই মামুন বলেন, ‘দুই সপ্তাহ পেরিয়ে যাচ্ছে আমরা তো কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। র‌্যাব-পুলিশ কেউ আমাদের কোনো আপডেট দিতে পারছে না। পরিবারের সদস্যরা সবাই ভেঙে পড়েছেন।’

 গত ৩০ নভেম্বর ও ১ ডিসেম্বর রংপুর ও পাবনা থেকে পাবনা মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের দুই ছাত্র তানভীর আহম্মেদ তনয় ও জাকির হোসেন বিপ্লব নিখোঁজ হন। দুজনেরই বাড়িই রংপুরে। পাবনা মেডিকেল কলেজের এক নম্বর ছাত্রাবাসের পাশাপাশি কক্ষে থাকত তারা। গত রবিবার সকালে জাকির বাড়ি ফিরেছে। সে রাগ করে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল বলে দাবি করেছেন তার ভাই জাহাঙ্গীর। তবে তনয় এখনো বাড়ি ফেরেনি। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের দাবি, তনয়কে উদ্ধারের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সংস্থা নিজেদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। জঙ্গিবাদের প্রাথমিক পর্যায়ে তনয়ের যোগসূত্র রয়েছে বলেও ওই সূত্র নিশ্চিত করেছে। এছাড়া ৩০ নভেম্বর বরিশালের আগৈলঝাড়া থেকে নিখোঁজ হওয়া নেয়ামতউল্লাহকে গত শুক্রবার রাজধানীর গেণ্ডারিয়া থেকে উদ্ধার করা হয়। বাবা-মায়ের সঙ্গে রাগ করে ঢাকায় পালিয়ে এসে একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করছিল মাদ্রাসার এই ছাত্র।

সর্বশেষ খবর