শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

যুদ্ধাপরাধের বিচারে মাইলফলক

আহমেদ আল আমীন

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে মাইলফলক অর্জন করেছে বাংলাদেশ। অন্যান্য সেক্টরের মতো যুদ্ধাপরাধ নামে পরিচিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারেও দেশটি অর্জন করেছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। যাদের বিচার ছিল একসময় অচিন্ত্যপ্রায়, তাদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে, বিচারের মুখোমুখি করে, সাজা এনে, অতঃপর তা কার্যকর করেও দেখিয়ে দিয়েছে দেশটি। একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও সহযোগীদের হাতে নির্যাতিত নারীদের (বীরাঙ্গনা) মুক্তিযোদ্ধা ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। এ এক বিশাল অর্জন। এ ছাড়া পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরুর বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য অর্জন। একাত্তরের বহু অপকর্মের রথী-মহারথী ও পালের গোদা কুপোকাত। একে একে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে গোলাম আযম থেকে শুরু করে নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী, সাকা চৌধুরী হয়ে সেই কাদের মোল্লা পর্যন্ত সবাইকে। বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিত ৪৮ জনের মধ্যে বেশির ভাগই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত। এর মধ্যে চূড়ান্ত বিচার শেষে ছয়জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। সেসব এখন ইতিহাস। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের হয়ে মামলা পরিচালনাকারী প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘‘গত ৪৫ বছরে বাংলাদেশ বিভিন্ন সেক্টরে অভাবনীয় উন্নতি ও সাফল্য অর্জন করেছে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর অন্যতম বড় অর্জন এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। বিচারকে এত দূর পর্যন্ত নিয়ে আসা, বাধা-বিঘ্ন উপেক্ষা করে চালিয়ে যাওয়া রাষ্ট্র্র হিসেবে আমাদের এক বিশাল সাফল্য। যেসব দেশ গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা ভাবতেও পারে না, আজ তাদের সামনে জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ। দীর্ঘ সময় পরে হলেও আমরা লড়াই করে, বিচার করে শাস্তির আওতায় এনেছি মুক্তিযুদ্ধের অপরাধীকে। একাত্তরের বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের ‘সমরনায়ক’ আখ্যায়িত করে ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, তাদের প্রাপ্য সম্মান, সামাজিক নিরাপত্তা ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়টি সরকারের দেখা উচিত। এসবই বা কম কিসে।’’

জানা গেছে, কিছু বিতর্ক ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া এই বিচারে সাফল্যের পাল্লাই ভারী। বিচারাধীন অন্য মামলাগুলোতেও অনুরূপ সফলতা অর্জনের পাশাপাশি রায় কার্যকরের ধারাবাহিকতা রাখতে পারাটাই এখন ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় মানবতাবিরোধী অপরাধসহ বিভিন্ন অপরাধের কয়েকশ অভিযোগের তদন্ত চলছে। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, প্রসিকিউশন টিম ও তদন্ত সংস্থা। পরে মামলার প্রয়োজনে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলেও সেটি এখন নিষ্ক্রিয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বর্তমান চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক। এই ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দী। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সদস্য তিনজন। ট্রাইব্যুনালের বর্তমান সদস্যরা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি। চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু। তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান। ট্রাইব্যুনালে নিষ্পন্ন হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে বিচারিক এই আদালতের প্রথম রায়টির কথা আসবে সবার আগে। ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি এই রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সদস্য আবুল কালাম আযাদকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। আসামি পলাতক থাকায় এ মামলায় আপিল হয়নি। এরপর আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন দণ্ড দেয় আদালত। আপিল বিভাগে দণ্ড বেড়ে এই মামলায় আসামির ফাঁসির আদেশ হলে তা কার্যকর করে সরকার। এরই মধ্যে কামারুজ্জামান, মুজাহিদ, সাকা চৌধুরী, নিজামী ও মীর কাসেমকে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির আদেশ আপিল বিভাগে বহাল থাকায় তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে সরকার। বুদ্ধিজীবী হত্যায় আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মাঈনুদ্দীনের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। তারা বিদেশে পলাতক। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ড হয় ট্রাইব্যুনালে। এর বিরুদ্ধে তিনি আপিল করলে সাজা কমিয়ে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন আপিল বিভাগ। এ রায়ের বিরুদ্ধে সরকার ও আসামিপক্ষের দুটি রিভিউ এখনো শুনানির অপেক্ষায়। গোলাম আযম ৯০ বছরের সাজা মাথায় নিয়ে আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় মারা গেছেন। এর বাইরে আপিল বিভাগ ও ট্রাইব্যুনালে আরও বেশ কিছু মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর