সোমবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

রাষ্ট্রপতিকে সব বলল বিএনপি

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাষ্ট্রপতিকে সব বলল বিএনপি

বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির পক্ষে নেতৃত্ব দেন দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া —পিআইডি

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকে সব কথাই বললেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের পর চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন বিএনপি প্রধান। এ সময় রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার অনুরোধও করেন তিনি। নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি নিয়ে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে বৈঠকে গতকাল নানা প্রসঙ্গ তুলে ধরেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। জবাবে রাষ্ট্রপতি বলেন, সংলাপের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করি এর মাধ্যমে চলমান সংকট নিরসন হবে। বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপকালে এসব তথ্য  নিশ্চিত হওয়া গেছে। বৈঠকে সার্চ কমিটি গঠন, নির্বাচন কমিশন নিয়োগ ছাড়াও গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ (আরপিও) সংশোধনের প্রস্তাব দেন বেগম জিয়া।  গতকাল বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী এই বৈঠকে নির্বাচন কমিশন গঠনে প্রস্তাবনা ছাড়াও চলমান রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন বেগম জিয়া। এ সময় তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে সার্চ কমিটি ও নির্বাচন কমিশন গঠনে পাঁচজন করে মোট ১০ জনের নামের প্রস্তাবিত তালিকা সংবলিত একটি ফাইল রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তর করেন। এ সময় রাষ্ট্রপতি বিএনপি প্রধানকে আশ্বস্ত করে বলেন, এ নিয়ে তিনি অন্যান্য রাজনৈতিক দলেরও মতামত নেবেন। প্রয়োজনে তিনি সার্চ কমিটি গঠনে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আরেকদফা বৈঠক করবেন।  সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গে রাষ্ট্রপতি বসবেন আগামীকাল বিকাল ৩টায়। পরদিন বিকাল ৩টায় লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) ও সাড়ে ৪টায় কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এবং বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় সরকারের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সঙ্গে বসার কথা রয়েছে রাষ্ট্রপতির। পরে পর্যায়ক্রমে আরও কয়েকটি দলকে আলোচনায় ডাকা হবে।

বৈঠক শেষে বেরিয়ে এসে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। এ সময় তিনি বলেন, বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে। সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে বলেও আমরা মনে করি। এদিকে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন সাংবাদিকদের জানান, বিএনপির প্রস্তাব নির্বাচন কমিশন গঠনে সহায়ক হবে। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে দলের নেতাদের নিয়ে বঙ্গভবনে পৌঁছান বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। বঙ্গভবনে তাকে স্বাগত জানান রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের অতিরিক্ত সচিব ওয়াহিদুল ইসলাম খান। পরে রাষ্ট্রপতি এসে বেগম জিয়ার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। এ সময় রাষ্ট্রপতি বলেন, কেমন আছেন? জবাবে বেগম জিয়া বলেন, মোটামুটি ভালো আছি। এ সময় দুজনকেই হাস্যোজ্জ্বল দেখা যায়। এ সময় বেগম জিয়া হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি পরিহিত ছিলেন। পরে রাষ্ট্রপতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও স্থায়ী কমিটির সব সদস্যের সঙ্গে কথা বলেন। বৈঠকের আগে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে প্রায় ১৫ মিনিট খোলামেলা কথা বলেন রাষ্ট্রপতি। খালেদা জিয়ার সঙ্গে বিএনপির প্রতিনিধি দলে ছিলেন— দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, ড. আবদুল মঈন খান, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, নজরুল ইসলাম খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। শারীরিক অসুস্থতার জন্য স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম বৈঠকে অংশ নিতে পারেননি। অন্যদিকে তালিকায় থাকা স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। লিখিত বক্তব্যে খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতির উদ্দেশ্যে বলেন, বর্তমান বাস্তবতায় সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণমূলক, বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনই যথেষ্ট নয়। নির্বাচন কমিশনকে সর্বাধিক প্রশাসনিক ও লজিস্টিক সমর্থন প্রদান প্রতিরক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন ও নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা অসম্ভব। নির্বাচন কমিশন যাতে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পারে সে উদ্দেশ্যে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতিকে খালেদা জিয়া জানান, আমরা ভবিষ্যতে নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা যথাসময়ে জাতির সামনে উপস্থাপন করব। বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে রাষ্ট্রপতিকে ধৈর্যসহকারে তার বক্তব্য শোনার জন্য ধন্যবাদ জানান খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, আমরা মনে করি আমাদের প্রস্তাব যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। আশা করি ভবিষ্যতে এই বিষয়ে অধিকতর আলোচনার জন্য আপনি আমাদের আবারও আমন্ত্রণ জানাবেন। রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে আপনি যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা সফল হবে বলে আমরা আশা করি। লিখিত বক্তব্য ছাড়াও ইতিপূর্বে দলের পক্ষ থেকে ঘোষিত নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত ১৩ দফা প্রস্তাবনার একটি কপি রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করেন বেগম জিয়া। এ ছাড়াও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিএনপি প্রতিনিধি দলের সদস্যরা একটি ফটোসেশনেও অংশ নেন। রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে তাদের চা-মিষ্টি ছাড়াও বিভিন্ন রকমের ফল ও বিস্কুট দিয়ে তাদের আপ্যায়ন করা হয়। বৈঠক সূত্র জানায়, বিএনপি চেয়ারপারসন রাষ্ট্রপতিকে বলেন, আমরা নামের তালিকা দিলাম। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর তালিকার সঙ্গে নামের সদৃশ্য থাকলে তাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে স্বাগত বক্তব্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই। বিজয় দিবসে আমরা একটি র‌্যালিও করতে পারি না। আপনি দেশে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে কার্যকর উদ্যোগ নিন। বেগম জিয়ার বক্তব্যের পর রাষ্ট্রপতি জানান, এই সংলাপ ইতিবাচক বলে আমি মনে করি। দেশের চলমান সংকট নিরসনে এই সংলাপ ভূমিকা পালন করবে। আমি পর্যায়ক্রমে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করব। এরপর দ্বিতীয় দফায় আবারও সংলাপ করতে পারি।

বিএনপি আশাবাদী : বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে নয়াপল্টনে দলের কার্যালয়ে ফিরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, আমরা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকে খুশি হয়েছি, আশাবাদী হয়ে উঠেছি। নতুন ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতি যে সার্চ কমিটি গঠন করবেন, সে বিষয়ে বিএনপি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছে। বিএনপি সাবেক একজন প্রধান বিচারপতিকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে, যারা নতুন নির্বাচন কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করবেন। তাদের মধ্য থেকে সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি। সার্চ বা বাছাই কমিটিতে কোনো ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করা হয়েছে কি না— প্রশ্ন করা হলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা বলেছিই তো সার্চ কমিটির ব্যাপারে আমাদের দলের চেয়ারপারসন সুনির্দিষ্টভাবে তার মতামত রাষ্ট্রপতির কাছে দিয়েছেন। 

বিএনপির প্রস্তাব ইসি গঠনে সহায়ক হবে— রাষ্ট্রপতি : নির্বাচন পরিচালনায় ইসির ভূমিকাই যে ‘মুখ্য’, তা মনে করিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ও তাদের মতামত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বঙ্গভবনের দরবার হলে ঘণ্টাব্যাপী এই আলোচনা শেষে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন সাংবাদিকদের সামনে বৈঠকের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে বিএনপির প্রতিনিধি দল আলোচনায় অংশ নিতে আসায় রাষ্ট্রপতি শুরুতেই তাদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাই মুখ্য। একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন ও সার্চ কমিটি গঠনের ব্যাপারে বিএনপি যেসব প্রস্তাব পেশ করেছে সেগুলো সহায়ক হবে।  জয়নাল আবেদীন রাষ্ট্রপতির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, বিএনপির মতামত পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠনে ইতিবাচক অবদান রাখবে। যে কোনো বিষয়ে আলোচনা ও মতবিনিময় সমাধানের বহুমুখী পথের সন্ধান দেয়। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আলোচনায় আমন্ত্রণ জানানোয় বিএনপি চেয়ারপারসন রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ দেন এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। নির্বাচন কমিশন ও সার্চ কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি একটি লিখিত প্রস্তাব আলোচনায় তুলে ধরেন। এ ছাড়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন ও নির্বাচন কমিশন শক্তিশালীকরণে তাদের প্রস্তাবও তিনি তুলে ধরেন। প্রেস সচিব আরও বলেন, বিএনপি রাষ্ট্রপতির এ উদ্যোগের সফলতা কামনা করেছে এবং এ ব্যাপারে তাদের সার্বিক সহযোগিতা থাকবে বলে জানিয়েছে।

হাস্যোরসে রাষ্ট্রপতি : তিন বছর পর বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার। এ সময় হাস্যোরসে অনেক কথাই বলেন রাষ্ট্রপতি। স্মরণ করেন স্পিকার হিসেবে সংসদে দায়িত্ব পালনের সময় বিএনপির নেতাদের সঙ্গে তার অতীত দিনের কথা। শুরুতেই রাষ্ট্রপতি দরবার হলে এসেই বিএনপি চেয়ারপারসনের কাছে জানতে চান, তিনি কেমন আছেন। জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আছি, মোটামুটি আছি।’ এরপর বিএনপির অন্য নেতাদের সঙ্গেও কুশল বিনিময় করেন রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এ সময় তার স্পিকার থাকার দিনগুলোর কথা স্মরণ করে সাবেক বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে বলেন, ‘আগে সংসদে থাকতে তো দেখা হতো। এখন তো আমি দূরে থাকি।’ এ সময় রাষ্ট্রপতি ও বেগম জিয়া হেসে উঠেন। ব্যারিস্টার মওদুদকে রাষ্ট্রপতি বলেন, কেমন আছেন সিনিয়র? জবাবে মওদুদ বলেন, খারাপ না। দিনে দিনে আপনি (রাষ্ট্রপতি) তরুণ হয়ে যাচ্ছেন। এ সময় হেসে উঠেন সবাই। ড. মোশাররফের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের সময় রাষ্ট্রপতিকে তিনি বলেন, আপনি কি এখন হাঁটাহাঁটি করেন না? রাষ্ট্রপতি বলেন, হাঁটব কেমনে, যেভাবে পেছনে লোকজন (নিরাপত্তায়) দাঁড়িয়ে থাকে। আমি তো এক ধরনের বিলাসী বন্দী জীবনযাপন করছি। ড. আবদুল মঈন খানের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের সময় রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘কী নাতিন জামাই কেমন আছেন?’ পরে নিজের চেয়ারে বসে খালেদা জিয়ার উদ্দেশে আবদুল হামিদ বলেন, ‘মঈন সাহেবতো আমার নাত জামাই।’ খালেদা হেসে বলেন, ‘তাই নাকি?’ বৈঠকে বিএনপি প্রতিনিধি দলকে সাত পদে (ফলের রস, ফিশ ফিঙ্গার, চিকেন পেটিস, চিকেন স্যান্ডউইচ, কাজু বাদাম, গুড়ের সন্দেশ আর চা) দিয়ে আপ্যায়িত করা হয়। বিকাল ৫টা ৪০ মিনিটে আলোচনা শেষে সবাইকে বিদায় জানান রাষ্ট্রপতি হামিদ।

সর্বশেষ খবর