সোমবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

প্রভাষক নিয়োগে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন : টিআইবি

নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক নিয়োগে তিন থেকে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। টাকা নিয়ে নিয়োগ দেওয়ার পর প্রার্থীকে কল্যাণ তহবিল থেকে ঋণ পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাসও দেওয়া হচ্ছে। গতকাল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়।

‘সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক নিয়োগ; সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এই সংবাদ সম্মেলন ধানমন্ডির টিআইবি কার্যালয়ে করা হয়। টিআইবি জানায়, তারা গত ২০০১ সাল থেকে ২০১৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দেশের ১৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে। এ বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত গবেষণার তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের কাজ সম্পন্ন করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। লিখিত প্রতিবেদন তুলে ধরেন টিআইবির প্রোগ্রাম ম্যানেজার রেযাউল করিম ও দিপু রায়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক নিয়োগে পূর্ণাঙ্গ বিধিমালা নেই। জবাবদিহিতা না থাকায় পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে ইচ্ছামতো চাহিদা তৈরি করা হয়। সিন্ডিকেটে ক্ষমতাসীন দলের সদস্য সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকায় পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে নিয়োগের যোগ্যতা নির্ধারণ করার সুযোগ থাকে না। শিক্ষক নিয়োগের পূর্বে পছন্দের শিক্ষার্থীর একাডেমিক পরীক্ষার ফল ইঞ্জিনিয়ারিং করে বাড়ানো হয়। শিক্ষার্থীদের বাজার করানোসহ বিভিন্ন ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করার বিনিময়ে পরীক্ষার প্রশ্ন সম্পর্কেও ধারণা দেন শিক্ষকরা। নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমেও পরীক্ষার নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া, প্রশ্ন জানিয়ে দেওয়া হয়। পরে এই ছাত্রীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অপরদিকে অপছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ না দিতে পরীক্ষার ফল দেরিতে প্রকাশ করার ঘটনাও বিরল নয়। এতে আরও উল্লেখ করা হয়, অনেক ক্ষেত্রে কোর্স, ক্লাস যথাযথভাবে যাচাই না করেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে চাহিদাপত্র তৈরি করা হয়। প্রয়োজনীয়তা যাচাই না করে ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী বা ভোটার বৃদ্ধির জন্যও নতুন বিভাগ খুলে বা এক বিভাগ ভেঙে নতুন বিভাগ তৈরি করে সেখানে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের পছন্দের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীর জন্য যেকোনো শর্ত শিথিলযোগ্য’ উল্লেখ করে আবেদনের যোগ্যতা পরিবর্তন, গ্রেডিং হ্রাস-বৃদ্ধি, নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রকাশনা বা থিসিস থাকতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়। ‘বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত সংখ্যার কম বা বেশি হতে পারে’ শর্ত দিয়ে এই নিয়মের অপব্যবহার করা হয়। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগীয় চেয়ারম্যান ও শিক্ষকদের না জানিয়ে বা চাহিদাপত্র ছাড়াই প্রশাসন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে থাকে। নিয়ম লঙ্ঘন করে সিন্ডিকেটের অনুমোদন ছাড়াও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ভিন্ন রাজনীতির মতাদর্শ ও অপছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে কম প্রচারিত পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। কমপক্ষে তিন সপ্তাহ আবেদনের সময় থাকার কথা থাকলেও আবেদনের সময়ও কমিয়ে দেওয়া হয়। অপছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ না দিতে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাদের মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হয় না। কোন প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া হবে তা নিয়োগ কমিটির সদস্যদের মধ্যে আগেই নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। নিয়োগ বোর্ড কর্তৃক অনুষ্ঠিত পরীক্ষা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তির অতিরিক্ত একজন প্রভাষক নিয়োগের নিয়ম থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিজ্ঞপ্তির দ্বিগুণ এবং ক্ষেত্র বিশেষে তিনগুণ নিয়োগেরও প্রমাণ রয়েছে কিছু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। অযোগ্য প্রার্থীকে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে প্রার্থিতা বাতিলের সুযোগ থাকলেও সিন্ডিকেট সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক হতে পারে ভেবে বা পদোন্নতিতে অনৈতিক সুবিধা নিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নীরব থাকে। অপছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ না দিতে অবান্তর ও হয়রানিমূলক বিভিন্ন মন্তব্য করে থাকেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১১টিতেই নিয়ম বহির্ভূতভাবে বিজ্ঞপ্তির অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকেন ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, এমপি, ছাত্রনেতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী শিক্ষক ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। তারা উপাচার্য, উপ-উপাচার্যসহ সংশ্লিষ্টদের ওপর নিয়োগ দিতে চাপ দেন। নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে রাজনৈতিক মতাদর্শ যাচাই প্রথার অপব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়াও উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তারা নিজেদের স্বামী, স্ত্রী, সন্তান, ভাইবোন, জামাতা, শ্যালক, শ্যালিকাসহ আত্মীয়স্বজনকে নিয়োগ দিচ্ছেন অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে। এক উপাচার্য সন্তানকে নিয়োগ দিতে গিয়ে সেই প্রার্থীর থেকে ভালো ফলাফলধারী সব আবেদনকারীকেই নিয়োগ দিয়েছেন। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে নিয়োগ প্রদান ছাড়াও ঋণ পরিশোধ করতে প্রার্থীকে বলছেন, ‘আমার লোন পরিশোধ করে দিলে তোমারও লাভ হবে, আমারও লাভ হবে।’ নিয়োগে অর্থ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত থাকছেন উপাচার্য, শিক্ষক নেতা, ছাত্রনেতা, ক্ষমতাসীন দলের নেতাসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও। নিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িতদের সঙ্গে সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তি, মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একাংশের সম্পর্ক রয়েছে।

সর্বশেষ খবর