বুধবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

মজুরি জটিলতা কাটেনি

জিন্নাতুন নূর

মজুরি জটিলতা কাটেনি

মজুরি বৃদ্ধিসহ বেশ কয়েকটি দাবিতে সাভারের আশুলিয়ায় পোশাক কারখানার শ্রমিকরা গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করছেন। এরই মধ্যে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্যে, চলমান পরিস্থিতি সামাল দিতে আশুলিয়ার ৫৫টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আর শ্রমিক সংগঠনগুলোর দেওয়া তথ্যে, মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকরা ছয় মাস ধরে তত্পর আছেন। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে এই আন্দোলনকে ‘ষড়যন্ত্র’ বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। এমনকি কাজে ফিরে না গেলে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলগুলো হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। আর শ্রমিক নেতারা বলছেন, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি না করে কোনোভাবেই এ আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। এ পরিস্থিতিতে মজুরি নিয়ে পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে।

আশুলিয়ার বিভিন্ন কারখানার আন্দোলনরত শ্রমিকদের অভিযোগ,  তারা নিয়ম অনুযায়ী গ্র্যাচুইটি পান না। প্রয়োজনমতো ছুটিও পান না। আর ছুটি নিলে বেতন পান না। কথায় কথায় সেখানকার কারখানাগুলোতে চলে শ্রমিক ছাঁটাই। শ্রমিকদের ভাষ্য অনুযায়ী, তারা বর্তমানে যে বেতন পান তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। ঘর ভাড়া দিয়ে তাদের হাতে যে অর্থ অবশিষ্ট থাকে, তা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে কোনোরকম মাস পার করছেন। তারা আরও জানান, প্রতিবাদ করলেই মিথ্যা অভিযোগে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। আর মালিকপক্ষের অশালীন ব্যবহারও তাদের সইতে হয়। এ জন্য তারা নিজেদের দাবি বাস্তবায়নে কর্মবিরতিসহ বিক্ষোভ করছেন। এতে আশুলিয়ার বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানায় উৎপাদন বন্ধ থাকায় মালিকপক্ষ ক্ষতির মুখে পড়ছে। পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর এক সংবাদ সম্মেলনে গতকাল জানানো হয়, চলমান শ্রমিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আশুলিয়ার ৫৫টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে দিয়েছে। সংস্থাটির সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমাদের উদ্যোক্তারা বাংলাদেশ শ্রম আইনের ১৩(১) ধারা অনুযায়ী অনির্দিষ্টকালের জন্য আশুলিয়া এলাকার কারখানাগুলো বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন। কারখানায় কাজ না করলে কোনো শ্রমিক আইন অনুযায়ী বেতন পাবেন না।’ এদিকে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু গতকাল সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে কোনো ষড়যন্ত্রে কান না দিয়ে শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বলেন। অন্যথায় আন্দোলনরত শ্রমিকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি হুঁশিয়ারি দেন। তিনি জানান, শ্রমিকদের পক্ষ থেকে বেতন বৃদ্ধিসহ কোনো ধরনের দাবি সরকারের কাছে করা হয়নি। তবে শ্রমিকরা লিখিত দাবিদাওয়া জানালে তা বিবেচনায় এনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ২০১০ থেকে ২০১৩ সালে তিন বছরের মধ্যে দুইবার পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২২৩ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। আবার পাঁচ বছর পর বেতন বৃদ্ধির সুযোগ আছে। এর আগে সোমবার আন্দোলনরত শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ও শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে আগামী তিন বছর আশুলিয়া এলাকার কোনো বাড়ির ভাড়া বৃদ্ধি করা হবে না বলে জানান। তিন বছরে কোনো বাড়ির মালিক যদি সেই এলাকায় ভাড়া বৃদ্ধি করেন, তবে তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা নেবে। সোমবারের বৈঠক শেষে শ্রমিকরা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে নিলেও গতকাল সকালে কারখানায় প্রবেশ করে কিছুক্ষণ থেকেই ফের বেরিয়ে আসেন। মালিকপক্ষ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারখানায় ছুটি ঘোষণা করে। এদিন আশুলিয়া-ইপিজেড সড়কে শ্রমিকরা বিক্ষোভসহ কয়েকটি গাড়িও ভাঙচুর করেন। কথা হলে শ্রমিক নেতারা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, চলতি বছরের মে মাস থেকেই শ্রমিকদের মূল বেতন ১০ হাজার এবং অন্যান্য খরচসহ মোট ১৬ হাজার টাকা মজুরি নির্ধারণের জন্য তারা সংবাদ সম্মেলন করেন। এ দাবির লিখিত কপিও তারা সরকারের মজুরি বোর্ডসহ পোশাক মালিকদের সংগঠনগুলোকে পৌঁছে দিয়েছেন। অর্থাৎ শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির তত্পরতা ছয় মাস ধরে চলছে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছে। ফলে শ্রমিকদের এ আন্দোলনে কোনো ষড়যন্ত্র নেই বলে তারা দাবি করেন। গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে গতকাল বলেন, যেহেতু আশুলিয়ায় সব শ্রমিক সংগঠন আছে, এ জন্য সেখানকার শ্রমিকরাও একটু বেশি সচেতন। শ্রমিকদের হুমকি দিয়ে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সমাধানের জন্য শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে হবে। সরকারের সব পর্যায়েই বেতন বৃদ্ধি হয়েছে। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। আর সরকারি পর্যায়ে বেতন বৃদ্ধির পর সবকিছুর দামই বেড়েছে। সব মিলিয়ে তিন বছর আগে যে মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে, এর সঙ্গে বর্তমান বাজারদর মোটেই সংগতিপূর্ণ নয়। এ জন্য শ্রমিকদের চলমান আন্দোলন ন্যায়সংগত। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি না করে কোনোভাবেই এ আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। আমরা চাই সরকার ও মালিকপক্ষ যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি মজুরি বোর্ড করবে, যেখানে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করা হবে। আর এমন ঘোষণা পেলেই শ্রমিকরা আন্দোলন বন্ধ করে কারখানায় ফিরবেন। উল্লেখ্য, এর আগে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি পায়। সর্বশেষ মজুরি বোর্ডের বেতন অনুসারে শ্রমিকরা এখন পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা পান। এর আগে ন্যূনতম মজুরি ছিল তিন হাজার টাকা। তিন বছর পর এবার শ্রমিকরা ন্যূনতম বেতন ১৫ হাজার টাকা করার দাবি জানিয়েছেন। শ্রম আইন অনুসারে প্রতিটি শিল্পের জন্য পাঁচ বছর পর পর ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠিত হয়। তবে সরকার চাইলে যে কোনো সময় মজুরি কাঠামো সংশোধন ও পরিবর্তনের ব্যবস্থা নিতে পারবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর