শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

জয় পরাজয়ের হিসাব নিকাশ

ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় নৌকার বিজয়

রফিকুল ইসলাম রনি

জয় পরাজয়ের হিসাব নিকাশ

অত্যন্ত সুষ্ঠু পরিবেশে নির্বাচন সম্পন্ন এবং দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করার প্রধান চ্যালেঞ্জ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল আওয়ামী লীগের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় সুফল ঘরে তুলতে পেরেছে ক্ষমতাসীন দলটি। দলের নীতিনির্ধারকরা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ নির্বাচনে দলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় জয়ী হয়েছেন নৌকার প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী। এ ছাড়াও পাঁচ বছর দায়িত্বে থাকার পরও বাংলাদেশের বাস্তবতায় আইভীর এই স্বচ্ছ ইমেজও কাজে লেগেছে জয়ী হতে।

জানা গেছে, গত ১৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ড ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন দেয়। নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মহানগরের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, বন্দর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ রশীদ ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা সভাপতি মজিবুর রহমান এই ৩ জনের নাম প্রস্তাব করে কেন্দ্রে পাঠানো হলেও মনোনয়ন বোর্ড সার্বিক বিচারে আইভীকেই মেয়র পদে দলীয় প্রার্থী হিসেবে বেছে নেয়। তার নাম ঘোষণার পর আলোচনায় আসে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়টি। গত ২২ নভেম্বর দলের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারায়ণগঞ্জের এমপি শামীম ওসমান, জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগকে ডেকে ?সাফ জানিয়ে দেন, দল করতে হলে দলের সিদ্ধান্ত মানতে হবে, আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে বিজয়ী করতে হবে। শেখ হাসিনার সেই নির্দেশের পর থেকেই স্থানীয় রাজনীতিতে কোন্দলের জমাট বরফ গলতে থাকে। নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা আইভীর পক্ষেই কাজ করতে তাদের ঐক্যের কথা বলতে থাকেন। সবশেষ ৯ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে ঐক্যের কথা বলেন শামীম ওসমান। এরপর এক সংবাদ সম্মেলন করে শামীম ওসমান দলীয় নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধভাবে নৌকার পক্ষে কাজ করতে নির্দেশ দেন। তিনি নিজেও একাধিকবার কেন্দ্রীয় ও মহানগর এবং জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সর্বশক্তি নিয়োগ করেন নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করতে। নৌকার প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী হলেও এ নির্বাচন শামীম ওসমানের জন্য ছিল এক অগ্নিপরীক্ষা। নাসিক নির্বাচনে আইভী বিজয়ী হলে শামীম ওসমানকে যেমন ক্রেডিট দেয়া হবে, আবার ফল বিপর্যয় ঘটলে তার খেসারতও দিতে হবে তাকে— এমন হুঁশিয়ারি ছিল দলের হাইকমান্ড থেকে। মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে তার মনোমালিন্য থাকলেও তাকে বিজয়ী করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন শামীম ওসমান। শামীম ওসমান ও আইভীর মধ্যে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্বের অবসান ঘটেছে যা নির্বাচনে আইভীর পক্ষে বড় ধরনের ইতিবাচক ফল এনে দিয়েছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা। এ ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, বন্দর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ রশীদ ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা সভাপতি মজিবুর রহমান মাঠে সক্রিয় ছিলেন বেশ। দলীয় প্রার্থীর পক্ষে রাতদিন কাজ করেছেন তারা। কারণ আইভী কোনো কারণে পাস না করলে দলীয় কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতো তাদেরও। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাই, সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসনাত শহীদুল্লাহ বাদলসহ সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও মাঠে ছিলেন সক্রিয়। তারাও রাতদিন পরিশ্রম করেছেন। গতকাল সন্ধ্যায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে নবনির্বাচিত মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী তাকে বিজয়ী করায় দলীয় নেতা-কর্মীদের ধন্যবাদ জানান।

দলীয় সূত্র মতে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের জন্য নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন ছিল চ্যালেঞ্জ। কারণ তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর এটাই দলীয় প্রতীকে প্রথম সিটি নির্বাচন। এ নির্বাচনে দলের প্রার্থীকে জয়ী করতে তিনি কেন্দ্রীয় নেতাদের দায়িত্ব বণ্টন করে দেন। একাধিক বৈঠক করেন কেন্দ্রীয় নেতা, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ভোট দলের পক্ষে নিয়ে আসতে ওই সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে নারায়ণগঞ্জে পাঠান আইভীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিতে।

দলের সিনিয়র নেতা ও প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহকে প্রধান সমন্বয়ক করে ২৭টি ওয়ার্ডের জন্য ১৪টি টিম গঠন করে দিয়েছিলেন তিনি। দলের সমন্বয়ক কাজী জাফরউল্লাহ ও নতুন দুই সাংগঠনিক সম্পাদক চট্টগ্রাম বিভাগের একেএম এনামুল হক শামীম ও ঢাকা বিভাগের ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসহ কেন্দ্রীয় নেতারা প্রচার-প্রচারণার শুরু থেকেই প্রায় সব সময় নির্বাচনী এলাকায় ছিলেন। নিজেরা প্রচারকাজে অংশগ্রহণ ছাড়াও কোথায় দুর্বলতা ছিল সেগুলো চিহ্নিত করেছেন। নিজেরা সমাধান করেছেন। যেখানে দলের সাধারণ সম্পাদকসহ শীর্ষ নেতাদের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন সেখানে সে কাজ করেছেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারা যেভাবে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছে অতীতের কোনো নির্বাচনে এমন কর্মতৎপরতা দেখা যায়নি বলে দলের একাধিক নেতা জানিয়েছেন। 

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হিসেবে সেলিনা হায়াৎ আইভীর হাতে মনোনয়নপত্র তুলে দেন। স্থানীয় দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটাতে দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী উভয় পক্ষকেই গণভবনে ডেকে পাঠান। উভয় পক্ষের অভাব-অভিযোগ শুনে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমানসহ সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে দলীয় প্রার্থী আইভীর পক্ষে কাজ করার নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রীকে শামীম ওসমান অঙ্গীকার করেন দলের প্রার্থীকে বিজয়ী করবেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে একেএম শামীম ওসমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নেত্রীকে (শেখ হাসিনা) কথা দিয়েছিলাম- যে কোনো মূল্যে জনগণের ভোটে নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করবই। সব ভেদাভেদ ভুলে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীকে মাঠে নামিয়েছিলাম। একটা কথাই বলব- ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগকে কেউ পরাজিত করতে পারে না। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন তার প্রকৃত উদাহরণ হিসেবে থাকবে।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ও দলের সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম এনামুল হক শামীম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সব ভেদাভেদ ভুলে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতা-কর্মী ঐক্যবদ্ধ হওয়া, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে এবং জনপ্রিয় প্রতীক নৌকা ও প্রার্থীর স্বচ্ছতার ক্লিন ইমেজ— এই তিন কারণে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমন্বয়ক ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের মানুষ এখন অনেক সচেতন হয়েছে। কেউ সন্ত্রাস-জ্বালাও-পোড়াও চায় না। এই বিজয় গণতন্ত্রের, এই বিজয় উন্নয়নের। তিনি বলেন, নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে আমরা স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিরোধ মেটাতে একাধিক বৈঠক করি। কেন্দ্রীয় টিম করে ভোটারদের ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট প্রার্থনা করি। ঐক্যবদ্ধভাবে সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা কাজ করায় আমাদের বিজয় হয়েছে।

এদিকে গতকাল এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আইভীর বিজয় শেখ হাসিনার প্রতি গণমানুষের আস্থার প্রতিফলন। শেখ হাসিনা দেশে যে উন্নয়ন করে চলেছেন- সেই উন্নয়নের প্রতি আস্থা জানাতেই নারায়ণগঞ্জের মানুষ মেয়র হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীকে বিজয়ী করেছে।

সর্বশেষ খবর