শিরোনাম
শনিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

আত্মসমর্পণ করা জঙ্গিরা কেউ জেলে কেউ সেফ হোমে

চলছে নিবিড় কাউন্সেলিং তিনজন ফিরেছেন স্বাভাবিক জীবনে

সাখাওয়াত কাওসার

র‌্যাব-পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণকারী জঙ্গিদের জীবন কাটছে ‘কারাগার’ আর ‘সেফ হোমে’। এদের কাউকে কাউকে নতুন মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আবার কয়েকজনকে সেফ হোমে রেখে কাউন্সেলিং করানো হচ্ছে।

কাউন্সেলিংয়ের পর ইতিমধ্যে দুজন ফিরে গেছেন পরিবারের কাছে। ফিরেছেন স্বাভাবিক জীবনে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধরা দেওয়া  সব জঙ্গিকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে মনোবিজ্ঞানী ও ইসলামী চিন্তাবিদদের মাধ্যমে নিবিড় কাউন্সেলিং চলছে। এরই মধ্যে চিন্তাধারায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। কথাবার্তা ও কাজকর্মে স্বাভাবিক মনে হওয়ায় দুজনকে ইতিমধ্যে তাদের পরিবারের কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে। কারাবন্দী একজন পেয়েছেন জামিনে মুক্তি। তবে তাদের ওপরও রয়েছে সার্বক্ষণিক নজরদারি। র‌্যাব ঘোষিত পুরস্কারের টাকা ধরা দেওয়া জঙ্গিদের দেওয়া হলেও পুলিশের কাছ থেকে আত্মসমর্পণকারীরা পাননি কিছুই। গত ৫ অক্টোবর বগুড়ার শহীদস্মৃতি মিলনায়তনে জঙ্গিবাদবিরোধী সমাবেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের উপস্থিতিতে র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করেন জঙ্গি আবদুল হাকিম (২২) ও মাহমুদুল হাসান বিজয় (১৭)। হাকিম আলিম পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করছেন। মাহমুদুল হাসান বগুড়া পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে অধ্যয়নরত। হাকিম রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলায় নিহত জঙ্গি খায়রুল ইসলাম পায়েলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহচর ছিলেন। খায়রুল ও হাকিম পঞ্চম শ্রেণি থেকে দাখিল পর্যন্ত ভিহি গ্রাম এডিইউ সেন্ট্রাল ফাজিল মাদ্রাসায় একই সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন। খায়রুলের প্ররোচনাতেই হাকিম জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়ান। মিরপুরে একটি জঙ্গি আস্তানায় ধর্মীয় উগ্রবাদের পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি অস্ত্র চালনা ও শারীরিক কসরতের প্রশিক্ষণ নেন। আত্মসমর্পণকারী বিজয় উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় প্রথমে ছাত্রশিবির পরে মুফতি জসীমউদ্দীন রাহমানীর ওয়াজ ও লিখিত বই পড়ে উগ্রপন্থায় জড়িয়ে পড়েন। নিষিদ্ধ জেএমবিতে যোগ দেওয়ার পর বোনারপাড়া, মহিমাগঞ্জ, সারিয়াকান্দি, বগুড়ায় জেএমবিদের বিভিন্ন সভায় যোগদান ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণের বিভিন্ন পর্যায়ে শিয়া মুসলিম, খ্রিস্টান নাগরিক ও হিন্দু পুরোহিতকে টার্গেট করে হত্যা বা সহযোগিতা করার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়। তাকে ‘থ্রিমা’ ও ‘ভিপিএন’ অ্যাপসের মাধ্যমে যোগাযোগ করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আত্মসমর্পণের আগে তিনি অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য বাছাই হয়েছিলেন। ২৩ নভেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে র‌্যাবের কাছে রংপুরে আত্মসমর্পণ করেন তিন জঙ্গি। এর মধ্যে হাফেজ মো. মাসুদ দিনাজপুর রামেশ্বরপুর মাদ্রাসার নবম শ্রেণির ছাত্র। মো. আকতারুজ্জামান ওরফে আকতারুল দিনাজপুরের নারায়ণপুর মিজবাহুল উলুম কওমি ও হাফেজিয়া মাদ্রাসার নবম শ্রেণির ছাত্র। মো. হাফিজুর রহমান দিনাজপুর কলাবাড়ী দাখিল মাদ্রাসার দশম শ্রেণির ছাত্র। সূত্র বলছে, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহে হামলায় অংশগ্রহণকারী জঙ্গি শফিউলের সঙ্গে এদের জঙ্গি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগসূত্র রয়েছে। শফিউলের মতো করে এরাও একই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জঙ্গি হিসেবে রিক্রুট হয়েছিলেন। শফিউলসহ এ তিনজনই নূরপুর সালাফিয়া ক্যাডেট মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। এরা শফিউলের চেয়ে দু-তিন ক্লাস জুনিয়র ছিলেন। ওই মাদ্রাসার পিয়ন আরিফুলের (পাগলী হত্যা মামলার আসামি হিসেবে হাজতে) মাধ্যমেই শফিউলের জঙ্গিবাদে হাতেখড়ি। আরিফুল স্থানীয় জঙ্গি রিক্রুটমেন্ট, প্রাথমিক প্রশিক্ষণ, শারীরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং ব্রেন ওয়াশ করে কোমল মনে জঙ্গিবাদ গেঁথে দিতেন। এ ছাড়া তাদের শরীরচর্চাবিষয়ক প্রশিক্ষক শাহাবুদ্দিন ও শফিউল একই সঙ্গে চর এলাকায় প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে শরীরচর্চা করাতেন। সূত্র বলছে, র‌্যাব সদর দফতরের অধীনে একটি সেফ হোমে নিবিড় কাউন্সেলিং চলছে আত্মসমর্পণকারী জঙ্গিদের। সেখানে মনোবিজ্ঞানী, মনোচিকিৎসক, ইসলামী চিন্তাবিদ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা তাদের স্বাভাবিক জীবনে আনার জন্য কাউন্সেলিং করছেন। এরই মধ্যে বগুড়ায় আত্মসমর্পণকারী আবদুল হাকিম ও মাহমুদুল হাসান বিজয়কে তাদের পরিবারের কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে। এখনো সেফ হোমে রয়েছেন আকতারুল। গতকাল তার বাবা সারোয়ার হোসেন মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘দুই দিন আগে আকতারুলের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। সে ভালো আছে। আশা করছি আমাদের মানিক স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।’ হাফেজ মাসুদের ভাই আতিয়ার বলেন, ‘মাসুদ এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো। মাঝেমধ্যে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। আমার বিশ্বাস সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে।’ তবে সেফ হোমের বিষয়টি এড়িয়ে যান র‌্যারেব আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, র‌্যাবের কাছে ধরা দেওয়া জঙ্গিদের বিরুদ্ধে আগে কোনো মামলা ছিল না। তাদের কাউন্সেলিং করা হয়েছে। এখন তারা পরিবারের সঙ্গে রয়েছেন। পুনরায় তারা যাতে জঙ্গিবাদে জড়াতে না পারেন সেজন্য তাদের ওপর মনিটরিং অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে, ১১ আগস্ট থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত তিন দফায় যশোরে ধরা দিয়েছেন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের সাত সদস্য। জেলা পুলিশ সুপার আনিসুর রহমানের নির্দেশনায় গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইমাউল হকের নেতৃত্বে এসব জঙ্গি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে এসে আত্মসমর্পণ করেন। এর মধ্যে চারজনের বিরুদ্ধে আগের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা ছিল বলে জানা গেছে। আত্মসমর্পণের আগে পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে যশোর জেলা পুলিশ ১১ জঙ্গির ছবি দিয়ে পোস্টার ও লিফলেট বিলি করে। লিফলেটে বলা হয়, এরা ধরা দিলে আইনি সহায়তা দেওয়া হবে। তখন ধরা দেন সাদ্দাম ইয়াসির সজল (৩২), রায়হান আহমেদ (২০), ফখরুল আলম তুষার (২১), মেহেদী হাসান পাশা (২০), তানজীব আহম্মেদ ওরফে আশরাফুল (২০), মাসুমা আক্তার (২৭) ও তানজীর আহম্মেদ তানজীর (১৮)। এক সপ্তাহ আগে সাদ্দাম ইয়াসির সজল আদালতের নির্দেশে জামিনে মুক্ত হন। পুলিশ বলছে, আত্মসমর্পণকারী জঙ্গিদের সবাই নিষিদ্ধ হিযবুত তাহ্রীরের সক্রিয় সদস্য। তাদের যশোর কোতোয়ালি থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়েরকৃত মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য তাদের কাউন্সেলিং করে কারাগারে পাঠানো হয়। আত্মসমর্পণকারী মেহেদী হাসান পাশার বাবা এ কে এম শরাফত মিয়া বলেন, ‘পাশের গ্রামের সজল নামে এক ছেলের পাল্লায় পড়ে আমার ছেলের এই দশা। তবে আমার বিশ্বাস মেহেদী স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে। আগামী জানুয়ারিতে কোর্টের শুনানি।’ এদিকে, এক প্রশ্নের জবাবে যশোর জেলা পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান বলেন, পুলিশ কারাগারের ভিতরে গিয়ে কাউন্সেলিং করতে পারে না। তবে কারাগারে পাঠানোর আগে তাদের কিছু সময়ের জন্য কাউন্সেলিং করা হয়েছিল। এ ছাড়া মাসিক বৈঠকে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির পক্ষ থেকে জেল সুপারকে এ বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য বলা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, কোনো জঙ্গি যদি জামিনে বের হন তাকে প্রতি সপ্তাহ কিংবা ১৫ দিন অন্তর ডিএসবি ও ডিবির সঙ্গে দেখা করতে বলা হয়। সর্বশেষ সজল জামিনে বের হওয়ার পর তাকে প্রতি সপ্তাহে ডিবি ও ডিএসবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করতে বলা হয়েছে। সেখানে তার কাউন্সেলিং হচ্ছে। এর বাইরে জঙ্গিদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে উৎসাহিত করার জন্য পোলট্রি খামার গড়তে বিনামূল্যে একটি মেশিন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে জেলা পুলিশ।

সর্বশেষ খবর