রবিবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

দুর্নীতি-সন্ত্রাস উন্নয়নের অন্তরায় ৩০ লাখ মামলা ঘাড়ে নেব না

----------প্রধান বিচারপতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

দুর্নীতি-সন্ত্রাস উন্নয়নের অন্তরায় ৩০ লাখ মামলা ঘাড়ে নেব না

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, ‘রাষ্ট্রের প্রতিটি সংস্থা অন্য সংস্থার ওপর আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। শুধু সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানগুলোই নয় রাষ্ট্রের বিভাগগুলোও এ প্রতিযোগিতার বাইরে নেই।’ সম্মেলনে বিচারকদের নির্দেশনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা আর ৩০ লাখ মামলার দায়িত্ব ঘাড়ে নিতে পারব না। আপনারা প্রসেস ইস্যু করবেন। তারপর ওয়ারেন্ট ইস্যু করবেন। সাক্ষী না এলে আপনারা মামলা নিষ্পত্তি বা খালাস করে দেবেন।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি রাষ্ট্রের কোনো অঙ্গ-বিভাগ বা সংস্থার সমালোচনা করছি না। যারা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে, তাদের মধ্যে এ আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতা বেশি মাত্রায় প্রতীয়মান হয়। কিন্তু বিচার বিভাগ এ প্রতিযোগিতায় কখনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি এবং করবেও না।’ প্রধান বিচারপতি গতকাল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দুই দিনের জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলন-২০১৬-এর উদ্বোধনীতে প্রধান অতিথির ভাষণ দিচ্ছিলেন। আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার সভাপতিত্বে সম্মেলনে বিশেষ অতিথি ছিলেন ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ, সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরী এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিরা, অ্যার্টনি জেনারেল মাহবুবে আলম, জেলা পর্যায়ের সব স্তরের বিচারকেরা সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে ‘বিচার বিভাগীয় তথ্য বাতায়ন’-এর উদ্বোধন করেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।  প্রধান বিচারপতি তার ভাষণে বলেন, আমরা সব সময় চেষ্টা করেছি রাষ্ট্রের বিভাগ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে শাসনতন্ত্র আমাদের যতটুকু দায়িত্ব এবং ক্ষমতা দিয়েছে আমরা শুধু ততটুকুই করব। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অন্যান্য বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানও বিচার বিভাগকে সহযোগিতা করবে বলে প্রধান বিচারপতি আশা প্রকাশ করেন। দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদ ও চোরাচালানকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্তরায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুর্নীতি দেশের উন্নয়নের প্রায় ৪০ শতাংশ ধ্বংস করে। এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেবল বিচার বিভাগই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। তিনি বলেন, গত দু-তিন বছরে দেশে যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, এর পিছনে বিচার বিভাগের অবদান অনস্বীকার্য। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখিয়েছে বিচার বিভাগ।

‘বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা থাকতে হবে’ : বিচারপতি এস কে সিনহা বলেন, বিচার প্রক্রিয়ায় ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে কিন্তু বিচারব্যবস্থা এবং বিচার বিভাগ সম্পর্কে জনগণের মনে আস্থা থাকতে হবে, এ আস্থা আমাদেরকেই তৈরি করতে হবে। সুপ্রিমকোর্টে এমন একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে যেখানে এসে বিচারপ্রার্থী মানসিকভাবে বিচার বিভাগ সম্পর্কে একটা ইতিবাচক ধারণা পোষণ করবে। শুধু প্রধান বিচারপতি বা সুপ্রিমকোর্টের পক্ষে এ ধারণা তৈরি সম্ভব না। এই ধারণা এবং বিশ্বাস তৈরির দায়িত্ব বাংলাদেশের সব বিচারকের। তিনি বলেন, দেশের প্রতিটি নিম্ন আদালতের পরিবেশ এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে বিচারপ্রার্থী জনগণ আদালত অঙ্গনে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে বিচার ব্যবস্থার প্রতি তার বিশ্বাস এবং আস্থার মাত্রা বেড়ে যায়।

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল সরানোর তাগিদ : বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, জেল হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন আলোচিত মামলায় জেলা আদালতে বিচার হয়েছে উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের মামলার বিচার সুপ্রিমকোর্ট অঙ্গনের বাইরে হতে অসুবিধা নেই। স্থান স্বল্পতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সুপ্রিমকোর্টের প্রশাসনিক ভবন নেই। বিচারক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের শিশুদের পরিচর্যার জন্য সুপ্রিমকোর্ট ডে কেয়ার সেন্টার এবং মেডিকেল সেন্টারের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার সংকট রয়েছে। সীমিত পরিসরে সুপ্রিমকোর্ট জাদুঘরে ঐতিহাসিক স্মারকসমূহ সংরক্ষণ করা হচ্ছে। পুরাতন হাইকোর্ট ভবন থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অন্যত্র সরিয়ে নিলে সুপ্রিমকোর্টের অবকাঠামোগত সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে। এ বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি তিনি আহ্বান জানান।

শূন্য পদে নিয়োগের তাগিদ : প্রধান বিচারপতি বলেন, তার ব্যক্তিগত উদ্যোগ, সুপ্রিমকোর্টের নিরবচ্ছিন্ন মনিটরিং এবং প্র্যাকটিস ডিরেকশন ইস্যুর ফলে বিচারকদের মধ্যে দ্রুত বিচার নিষ্পত্তির স্পৃহা বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট, গত বছরের চেয়ে চলতি বছরে নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালতে মামলা নিষ্পত্তির হার অনেক বেড়েছে। দেশের সব আদালতে ২০১৪ সালে নিষ্পত্তিকৃত ১৩,০৪,৫৪৪টি মামলা এবং ২০১৫ সালে নিষ্পত্তি হয়েছে ১৪,২৬,৬৭৬টি মামলা। উচ্চ আদালতে বর্তমানে বিচারাধীন মামলা ৪, ২৭, ১৫৪ এবং নিম্ন আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ২৭,১২,১২১। সুপ্রিমকোর্টে বর্তমানে ৯৮ জন বিচারক, নিম্ন আদালতে ১ হাজার ৩০০ বিচারক বিচারকার্য পরিচালনা করছেন। এত অল্পসংখ্যক বিচারক দ্বারা ৩০ লক্ষাধিক মামলা নিষ্পত্তি সম্ভব নয় উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি নিম্ন আদালতের শূন্য পদে দ্রুত বিচারক নিয়োগের তাগিদ দেন।

রাষ্ট্রের ক্রান্তিলগ্নে : ‘দেশের ভাবমূর্তি সমুজ্জ্বল করতে বিচার বিভাগের অবদান অন্য কোনো বিভাগের চেয়ে কম নয়’- জানিয়ে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, সব ক্রান্তিলগ্নে বিচার বিভাগ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছে। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যার বিচার করে অপরাধীদের শাস্তি প্রদান করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছে। জাতীয় চার নেতার বিচার করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এর ফলে জাতির দীর্ঘ দিনের কাঙ্ক্ষিত বিচার পাওয়ার প্রত্যাশা অনেকাংশেই পূরণ হয়েছে। এ ছাড়া জঙ্গিদের বিচার, ১০ ট্রাক অস্ত্র ও বিডিআর হত্যা মামলার বিচার করা হয়েছে। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী জনগণের সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রের প্রজাতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পরিচয় খর্ব করায় আদালত তা অসাংবিধানিক ও অবৈধ বলে ঘোষণা করে। ফলে জনগণের সার্বভৌমত্ব এবং ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আদালত পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনী বাতিল করে ঐতিহাসিক রায় প্রদান করে। সংবিধান থেকে সামরিক আইন তথা সামরিক শাসকদের সংশোধিত ও সন্নিবেশিত বিধানসমূহ মুছে ফেলে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই আদেশের ফলে সামরিক শাসনের সম্ভাবনা চিরতরে নির্বাসিত হয়েছে এবং গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করার সুযোগ পরাহত হয়েছে। প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে বিশেষ আদালতগুলোতে স্থান সংকুলানের অভাব, যোগ্য বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা, ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অবকাঠামোগত সমস্যার কথাও উঠে আসে। তিনি বলেন, তিনি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব গ্রহণের সময় ম্যাজিস্ট্রেসি বিল্ডিং নির্মাণকার্য যে অবস্থায় ছিল, তার শত চেষ্টা পর এখনো সে অবস্থায় রয়েছে। আদালতের স্থান সংকুলানের তীব্র সংকটের বিষয়টি তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীর নজরে এনেছেন। তবু আশাব্যঞ্জক ফল আসেনি।

প্রযুক্তির বিকল্প নেই : বিচারপতি সিনহা বলেন, মামলা ব্যবস্থাপনায় সংস্কার এবং দক্ষ সেবাদানের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিকল্প নেই। সফটওয়্যারের সহায়তায় মামলার তথ্য এখন সার্চ কমান্ড দিয়ে বের করা সম্ভব। বিচার ব্যবস্থার ডিজিটাইজেশনের পথে এরই মধ্যে আমরা কিছু এগিয়েও গিয়েছি। বিচার বিভাগের জন্য মনিটরিং ড্যাস বোর্ড তৈরি করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গ ৩০ লাখ মামলা : প্রধান বিচারপতি বলেন, আমাদের দেশে পুলিশ প্রশাসন অপরাধীদের গ্রেফতারের ব্যাপারে যতটা পারদর্শী, সাক্ষী উপস্থিতির ক্ষেত্রে ততটা নয়। এ কারণে মামলার ফলাফল হতাশাজনক হয়। দেশে ৩০ লক্ষাধিক মামলা বিচারাধীন উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব মামলার দায়িত্ব ঘাড়ে নিতে পারব না। প্রধান বিচারপতি সম্মেলনে বিচারকদের নির্দেশনা দিয়ে বলেন, ‘আমরা আর ৩০ লাখ মামলার দায়িত্ব ঘাড়ে নিতে পারব না। আপনারা প্রসেস ইস্যু করবেন। তারপর ওয়ারেন্ট ইস্যু করবেন। সাক্ষী না এলে আপনারা মামলা নিষ্পত্তি বা খালাস করে দেবেন।’

ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমি : প্রধান বিচারপতি বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিচারক ও বিচার প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্টদের আধুনিক প্রশিক্ষণ, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমি রয়েছে। আমাদের দেশের উচ্চ আদালতের বিচারকদের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। একটি পূর্ণাঙ্গ ও আধুনিক মধ্যম মানের ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমির জন্য কমপক্ষে ২৫ একর জামির প্রয়োজন। এই জমি পেলে সুপ্রিমকোর্টের তত্ত্বাবধানে এবং দেশি-বিদেশি দাতা সংস্থার অর্থায়নে একটি ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমির কাজ শুরু করা সম্ভব। তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছেন। কিন্তু আজও আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়া যায়নি।

সর্বশেষ খবর