সোমবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
শঙ্কামুক্ত নয় শিশু সাবিনা

মুসাই হাল ধরেছে নব্য জেএমবির

১৯টি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড ও দুটি সুইসাইডাল ভেস্ট উদ্ধার

সাখাওয়াত কাওসার

শীর্ষ জঙ্গি মাঈনুল ইসলাম ওরফে মুসার নেতৃত্বেই চলছে নব্য জেএমবি। আশকোনা পূর্বপাড়ার তিনতলা বাড়িটিতেই নব্য জেএমবির প্রধান অফিস হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল সে। আত্মগোপনে থেকেই ভয়ঙ্কর নাশকতার পরিকল্পনা করেছিল। অতি গোপনে ওই আস্তানায় মজুদ করা হয়েছিল অস্ত্র-গোলাবারুদ ও বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক। দৈনন্দিন খরচ, সাংগঠনিক কার্যক্রম ও অপারেশন বাবদ নগদ ১২ লাখ টাকা রাখা ছিল ওই ভবনে। তবে পুলিশি অভিযানের পর ১২ লাখ টাকা, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোনসহ অফিসে থাকা গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলেছে জঙ্গিরা। আত্মসমর্পণকারী জেবুন্নাহার শিলার কাছ থেকে এমনই তথ্য আদায় করতে পেরেছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে নিহত নারী জঙ্গি তৃষার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। তবে এখনো আশঙ্কামুক্ত নয় বিস্ফোরণে আহত শিশুটি। এ ছাড়া জঙ্গি আস্তানায় পড়ে থাকা তানভীর কাদেরীর ছেলের মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে।

 সূত্র বলছে, নব্য জেএমবির মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী নিহত হওয়ার পর সংগঠনের হাল ধরেছিলেন তানভীর কাদেরী। আজিমপুরে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে মারা যায় সেও। এরপর আশুলিয়ায় র‌্যাবের অভিযানে মারা যায় আরেক শীর্ষ জঙ্গি সারোয়ার জাহান। ভারতে পালিয়ে গেছে শীর্ষ জঙ্গি মামুনুর রশিদ রিপন। নূরুল ইসলাম মারজান, বাশারুজ্জামান চকলেট ও রাজীব গান্ধী লাপাত্তা গুলশান হামলার পর থেকেই। এ কারণে নব্য জেএমবির হাল ধরেছিল মাঈনুল ইসলাম ওরফে মুসা। তার পরিকল্পনা ছিল ‘বড় হামলা’র। আস্তানা হিসেবে ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার জন্য ইমতিয়াজ আহমেদ নামের ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে জমা দিয়েছিল মুসা। মাঈনুল ইসলাম মুসার গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর বাগমারার রঘুপাড়া ইউনিয়নের বুজরুখকুলায়। রাজশাহীর তাহেরপুর কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর রাজশাহী নিউ ডিগ্রি কলেজ থেকে বিএ পাস করে সে। পরে ঢাকা কলেজ থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স পাস করার পর উত্তরা লাইফ স্কুলে চাকরি শুরু করে। ২০১৪ সালে বাগমারা সাইপাড়ার আবদুস সামাদের মেয়ে মোসাম্মৎ তৃষা মনিকে বিয়ে করে মুসা। তাদের চার মাস বয়সী এক শিশুসন্তান রয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কাছে তথ্য ছিল নব্য জেএমবির হাল ধরার চেষ্টা করছিল মাঈনুল ইসলাম ওরফে মুসা। এ জন্য মুসাকে গ্রেফতার করতে আমরা নানাভাবে চেষ্টা করছিলাম। সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’ তিনি বলেন, আস্তানা থেকে সর্বমোট ১৯টি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড, দুটি সুইসাইডাল ভেস্ট, বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক এবং তিনটি নাইন এমএম পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। আস্তানার পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে জঙ্গিরা সেখানে থাকা গুরুত্বপূর্ণ সব নথি ও টাকা-পয়সা পুড়িয়ে ফেলেছে। বিস্ফোরণে আহত শিশুটি শঙ্কামুক্ত বলে জানান তিনি। সিটিটিসি সূত্রমতে, উত্তরার লাইফ নামের একটি স্কুলে শিক্ষকতার সময়ই মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ও তানভীর কাদেরীর সঙ্গে পরিচয় হয় মুসার। একপর্যায়ে নব্য জেএমবির দলে ভিড়ে যায় মুসা। ধীরে ধীরে সে নব্য জেএমবির গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠে। গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ছিল এই মুসা। তামিম চৌধুরীসহ নব্য জেএমবির তানভীর কাদেরী, জাহিদ, রাশেদ, জাহাঙ্গীর, মারজান, বাশারুজ্জামানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হতো তার। আজিমপুরে আস্তানা থেকে উদ্ধারের পর জাহিদের মেয়ে পিংকি ওই সময় সিটিটিসির কর্মকর্তাদের জানিয়েছিল, ‘মা মুসা আঙ্কলের বাসায় গিয়েছে।’ তাহরিম ও পিংকির দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরেই মুসাকে খুঁজতে শুরু করে পুলিশ সদস্যরা। তবে মুসার বিষয়টি তারা প্রথম জানতে পারেন ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরে অভিযানের পর। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আশকোনার আস্তানায় মুসার স্ত্রী-সন্তান থাকলেও সে নিয়মিত এখানে থাকত না। অন্য জঙ্গিদের স্ত্রীদের নিজের বাসায় রেখে সে অন্য একটি আস্তানায় থাকত। প্রতি মঙ্গল ও শুক্রবার সে আশকোনার বাসায় আসত। সেই হিসেবে শুক্রবার তার আশকোনার আস্তানায় আসার কথা থাকলেও আসেনি। মাঝেমধ্যে তার সঙ্গে ৪০ বছর বয়সী দাড়িওয়ালা এক ব্যক্তিও আসত। পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা, মুসা অন্য কোনো আস্তানাতেও একইভাবে বিস্ফোরক দ্রব্য দিয়ে হ্যান্ড গ্রেনেড তৈরি করছিল। নব্য জেএমবির অনেক নেতা-কর্মী নিহত ও গ্রেফতার হলেও মুসা নিজে দায়িত্ব নিয়ে সংগঠন গোছানোর কাজ করছিল। এ কারণে সে অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংগ্রহ করে। নিজের বাসায়ই হ্যান্ড গ্রেনেড ও সুইসাইডাল ভেস্ট তৈরি করে সে। সিটিটিসির অতিরিক্ত উপকমিশনার মোহাম্মদ ছানোয়ার বলেন, ‘প্রতিটি সুইসাইডাল ভেস্টে পাঁচটি করে হ্যান্ড-মেড গ্রেনেড রাখা হয়েছিল। সব গ্রেনেডের একটি ‘কি পয়েন্ট’ তৈরি করা হয়, যেন একটি পিন খুললেই পাঁচটি গ্রেনেড একসঙ্গে বিস্ফোরিত হতে পারে। নিহত নারী জঙ্গি তার শরীরে থাকা সুইসাইডাল ভেস্টের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। তবে ওই সময় দুটি গ্রেনেড খুলে পড়ে যায়। ওই দুটি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড আমরা উদ্ধার করেছি।’

শহীদ কাদেরীর পূর্বপুরুষ পাকিস্তানি : আশকোনার জঙ্গি আস্তানায় নিহত কিশোর আফিফ কাদেরী ওরফে শহীদ কাদেরী ওরফে আদরের পূর্বপুরুষ ছিলেন পাকিস্তানের নাগরিক। তার বাবা তানভীর কাদেরীর দাদা মরহুম মাওলানা আবদুল ওয়াহেদ ছিলেন পাকিস্তানের পেশোয়ার অঞ্চলের লোক। আনুমানিক ১৯১০ সালে বাংলাদেশে তাবলিগ করতে এসে গাইবান্ধার ফুলছড়িতে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে তার বাবা এস এম বাতেন কাদেরী গাইবান্ধা সদর উপজেলার বোয়ালী ইউনিয়নের পশ্চিম বাটিকামারী গ্রামে স্থায়ী হন।

শঙ্কামুক্ত নয় শশু সাবিনা : রাজধানীর পূর্ব আশকোনার জঙ্গি আস্তানা থেকে আহত অবস্থায় উদ্ধার চার বছরের শিশু সাবিনা এখনো শঙ্কামুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের চিকিৎসকরা। শিশুটিকে উদ্ধারের পর শনিবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে এনে অস্ত্রোপচারের পর ক্যাজুয়ালটি বিভাগের পোস্ট অপারেটিভে রাখা হয়েছে। শিশুটি জঙ্গি ইকবালের মেয়ে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তার মায়ের নাম শাকিরা। পুলিশের প্রায় ১৬ ঘণ্টার ওই অভিযানে জঙ্গি সুমনের স্ত্রী ও জঙ্গি তানভীর কাদেরীর ছেলে নিহত হয়। ক্যাজুয়ালটি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. জেসমিন নাহার জানান, শনিবার রাতে শিশুটির অস্ত্রোপচার করা হয়। স্প্লিন্টারের আঘাতে শিশুটির খাদ্যনালিতে ১০-১২টি ফুটো হয়েছে। তার বাম হাতও ভেঙে গেছে এবং শরীরে বিভিন্ন স্থানে কাটাছেঁড়া আছে। অস্ত্রোপচারের পর অবস্থা কিছুটা উন্নতি হলেও সে শঙ্কামুক্ত নয়। আমরা শিশুটিকে পর্যবেক্ষণে রেখেছি। ক্যাজুয়ালটি বিভাগের চিকিসক ডা. মোস্তাক আহমেদ জানান, গতকাল সকালে সাবিনা চিকিৎসকদের সঙ্গে কিছু কথা বলেছে। আমরা তার কাছ থেকে তথ্য জানার চেয়ে তার সুস্থতার দিকটিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। বয়সের তুলনায় তার আঘাত খুব বেশি। সাবিনার খোঁজ নিতে তার স্বজনদের মধ্যে কেউই যোগাযোগ করেনি। উল্লেখ্য, গত শুক্রবার মধ্যরাতে রাজধানীর আশকোনার ‘সূর্য ভিলা’ নামে একটি বাড়িতে জঙ্গিদের অবস্থান নিশ্চিত করে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস?্যরা। শনিবার সকালে দুই নারী ও দুই শিশুসহ চারজন আত্মসমর্পণ করে। তখনো এক নারী, এক কিশোর ও এক শিশু ভিতরে থেকে যায়। দুপুরের দিকে এক নারী জঙ্গি শিশু সাবিনার হাত ধরে বাসা থেকে বেরিয়ে এসে তার শরীরে থাকা বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে ওই নারী জঙ্গি ঘটনাস্থলেই মারা যায়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া শিশু সাবিনাকে দ্রুত ঢামেক হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ।

সর্বশেষ খবর