বুধবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

নজরদারিতে আসছেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

নজরদারিতে আসছেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব

জঙ্গি অর্থায়ন ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে দেশের রাজনীতিবিদ, সরকারের নীতিনির্ধারক এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে নজরদারির আওতায় আনার সুপারিশ করেছে এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিং (এপিজি)। ওই সুপারিশ আমলে নিয়ে একটি ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, যার ওপর বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারের সাংবিধানিক সংস্থাগুলোর মতামত চাওয়া হয়েছে। খসড়া প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভ্যন্তরীণভাবে মানি লন্ডারিংয়ের পাশাপাশি সাম্প্রতিককালে সন্ত্রাসী তথা জঙ্গি হামলা ও জঙ্গি অর্থায়নে যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে, সেই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়েই অ্যাকশন প্ল্যানটি তৈরি করা হচ্ছে। এ বিষয়ে এপিজির মিউচুয়াল ইভালুয়েশন রিপোর্টে যেসব সুপারিশ ও দিক নির্দেশনা রয়েছে সে বিষয়গুলোকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

সূত্রগুলো জানায়, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে ৩১ অক্টোবর সভা করেছে এ সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটি, যেখানে সভাপতিত্ব করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ওই সভায় খসড়া অ্যাকশন প্ল্যান চূড়ান্ত করার আগে বিভিন্ন সংস্থার মতামত নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।  এপিজির সুপারিশ অনুযায়ী খসড়া অ্যাকশন প্ল্যানে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঝুঁকিকে আমলে নিয়ে সব খাতকেই নজরদারির আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে, যার মধ্যে ‘পলিটিক্যালি এক্সপোজড পারসনস (পিইপিএস)’ শব্দটি বিশেষভাবে উল্লেখ রয়েছে। উইকিপিডিয়ায় এই বিশেষ শব্দটি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘রাজনৈতিকভাবে উন্মুক্ত ব্যক্তি যিনি বা যাকে পাবলিক ফাংশন বা সরকারি কার্যক্রমে ন্যস্ত করা হয়েছে, এ ছাড়া প্রবীণ রাজনীতিবিদ, ঊর্ধ্বতন সরকারি, বিচারিক বা সামরিক কর্মকর্তা, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন করপোরেশন বা বাণিজ্যিক সংস্থা, গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের নেতা বা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, উচ্চ পর্যায়ে কর্মরত ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে। সাধারণত যারা তাদের অবস্থান, শক্তি ও কর্মদক্ষতার দ্বারা ঘুষ ও দুর্নীতিতে সম্ভাব্য সম্পৃক্ততা এবং প্রভাব রাখতে পারেন।

তবে খসড়া অ্যাকশন প্ল্যানে ‘পলিটিক্যালি এক্সপোজড পারসন’ শব্দটি উল্লেখ থাকলেও এটি প্রত্যাহার করা হচ্ছে বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা। তিনি জানান, বিভিন্ন সংস্থার মতামতে ‘রাজনৈতিক’ ওই শব্দটি নিয়ে আপত্তি রয়েছে। ফলে এপিজি চাইলেও আমরা এই শব্দটি রাখতে চাই না। এর পরিবর্তে ‘ইনফ্লুয়েন্সিয়াল পারসন’ শব্দটি ব্যবহার করা হবে যেটি দিয়ে মূলত রাষ্ট্রের ‘প্রভাবশালী ব্যক্তি’ বোঝানো হবে।

পরিবর্তিত এই শব্দটি দিয়ে তদন্তের আওতা আরও ব্যাপক পরিসরে বাড়ানো যাবে উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, এক্ষেত্রে একজন গভর্নরকে যেমন জিজ্ঞাসাবাদ করার সুযোগ থাকবে একইভাবে একজন বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীকেও তদন্তের আওতায় আনা যাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ‘গভর্নর’ কীভাবে এবং কেন মানি লন্ডারিং বা জঙ্গি অর্থায়নে সন্দেহের তালিকায় আসতে পারেন—এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, গভর্নর যদি তার প্রভাব বিস্তার করে কোনো ব্যাংকের এমডি বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে এমন কোনো নির্দেশনা দেন, যেটি মানি লন্ডারিং বা জঙ্গি অর্থায়নে সম্পৃক্ত বলে বিবেচিত হয় সে ক্ষেত্রে তিনিও তদন্তের আওতায় আসবেন।

সূত্রগুলো জানায়, অ্যাকশন প্ল্যানটি চূড়ান্ত না হলেও এরই মধ্যে মানি লন্ডারিং এবং জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধে আইনি কাঠামো প্রয়োগে সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মাদক পাচার ও তার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে একজন সংসদ সদস্যকে গ্রেফতার করে (বর্তমানে জামিনে) আইনের আওতায় আনা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার চুরির বিষয়ে তদন্ত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সাবেক একজন গভর্নরকেও দুই দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এ ছাড়া জঙ্গি কার্যক্রমে অর্থায়ন সন্দেহেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে একাধিক ব্যবসায়ীকে। জঙ্গি অর্থায়নে নজরদারিতে রয়েছে সন্দেহভাজন অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তি ও তাদের প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন ও বিনিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে তদন্ত চলছে। এমন কি পানামা পেপারস কেলেঙ্কারির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী অর্থ পাচারের যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে এবং তাতে বাংলাদেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের যে নাম পাওয়া গেছে, সেই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছে দুদক, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা।

প্রসঙ্গত, চলতি বছরের শুরুর দিকে এপিজি যে প্রাথমিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন দিয়েছিল, সেখানে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বাংলাদেশকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ উল্লেখ করে বলা হয়েছিল, দেশটি জাতীয় ঝুঁকি নিরূপণে সন্ত্রাসে অর্থায়নকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করেনি। এমন কি এ বিষয়ে তাদের কোনো দালিলিক কর্ম-পরিকল্পনাও (অ্যাকশন প্ল্যান) নেই। এর পরপরই সরকারের পক্ষ থেকে বৃহৎ পরিসরে জঙ্গি অর্থায়ন ও মানি লন্ডারিং বন্ধে ওই অ্যাকশন প্ল্যান চূড়ান্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে এপিজি যুক্তরাষ্ট্রে যে বৈঠক করে সেখানে অবশ্য বাংলাদেশকে ঝুঁকিমুক্ত উল্লেখ করে ওই ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ চূড়ান্ত করতে বেশকিছু সুপারিশ ও দিক নির্দেশনা দেয় সংস্থাটি।

সর্বশেষ খবর