শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

পরাজয়ের যত কারণ

হিসাব-নিকাশ আওয়ামী লীগে, অনেক এলাকায় মন্ত্রী-এমপিরাও ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রার্থী জেতাতে পারেননি, চ্যালেঞ্জ-পাল্টা চ্যালেঞ্জের বিশ্লেষণ চলছে

গোলাম রাব্বানী ও রফিকুল ইসলাম রনি

জেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের পরাজয়ের পেছনে ছিল বেশ কয়েকটি কারণ। ‘আওয়ামী লীগ’ বনাম ‘এমপি-মন্ত্রী লীগ’ পরিস্থিতি ঘনিয়েছে বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি। ১৩ জন বিদ্রোহী প্রার্থী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন। দুর্বল প্রার্থীকে দলীয় সমর্থন, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, আগে দায়িত্বে থাকা কয়েকজন জেলা পরিষদ প্রশাসকের কর্মকাণ্ডে খুশি ছিলেন না ভোটাররা, বিএনপি-জামায়াতের ভোট বিদ্রোহীদের পক্ষে থাকায় তারা সহজেই পার পেয়ে গেছেন। তবে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদ নির্বাচনে কারও কারও বিরুদ্ধে অর্থ ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচনের পর এখন চলছে বিদ্রোহীদের নিয়ে হিসাব-নিকাশ। আবার অনেক এলাকায় মন্ত্রী-এমপিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রার্থী জেতাতে পারেননি। দলের ভিতরে-বাইরে চলছে চ্যালেঞ্জ পাল্টা চ্যালেঞ্জ। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও একই ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হতে পারে ক্ষমতাসীন দলকে— এমন শঙ্কাও রয়েছে।

গত বুধবার সারা দেশে ৩৮ জেলায় চেয়ারম্যান পদে ভোট গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে ২৫টি জেলায় আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নির্বাচিতদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। বাকি ১৩টি জেলায় জিতেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা, যারা আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। মাত্র দু-তিনটি জেলায় নির্দলীয় বা অন্য দলের প্রার্থী জয়ী বা প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিসেবে আবির্ভূত হতে পেরেছেন। অর্থাৎ ৫৯টি জেলা পরিষদের মধ্যে বিজয়ী বা প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে লড়েছেন আওয়ামী লীগের নেতারাই। প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে সদস্য পদপ্রার্থীদের ক্ষেত্রেও। পিরোজপুরে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের সমর্থন পান সাবেক জেলা পরিষদ প্রশাসক অধ্যক্ষ মো. শাহ আলম। দলীয় সভানেত্রীর সমর্থিত এই  প্রার্থীকে মেনে নিতে পারেননি জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সদর আসনের এমপি এ কে এম এ আউয়াল। শুরু থেকেই প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন তিনি। শুধু তাই নয়, নির্বাচন কমিশন, দলের সাধারণ সম্পাদক এবং স্পিকারের নির্দেশ উপেক্ষা করে নিজে বিভিন্ন জায়গায় বৈঠক করে বিদ্রোহী প্রার্থী মহিউদ্দিন মহারাজের পক্ষে ভোট চেয়েছেন— এই অভিযোগ করেন পরাজিত প্রার্থী শাহ আলম ও স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। জানা গেছে, সদর আসনের এমপির একক প্রভাব ধরে রাখতে শেখ হাসিনার সমর্থিত প্রার্থীকে পরাজিত করতেই মহারাজকে দাঁড় করান তিনি। শাহ আলম নির্বাচিত হলে আগামীতে তার রাজনীতি হুমকির মুখে পড়ার শঙ্কা ছিল বলে জানা গেছে। ভোটারদের এমপি আউয়াল নানাভাবে প্রভাবিত করেছেন বলে অভিযোগ। এদিকে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় বিষয়টি ভালোভাবে নেননি দলের হাইকমান্ড।

পঞ্চগড়ে আওয়ামী লীগ সমর্থন দেয় মো. আবু বক্কর সিদ্দিককে। দলের সমর্থিত প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থান নেন পঞ্চগড়-২ আসনের এমপি নুরুল ইসলাম সুজন। তিনি সমর্থন দেন বিদ্রোহী প্রার্থী মির্জা সারোয়ার হোসেনকে। অন্যদিকে সাবেক এমপি মাজহারুল ইসলাম দলের প্রার্থী আবু বক্কর সিদ্দিকের পক্ষে কাজ করলেও ফলোদয় হয়নি। কারও সমর্থন ছাড়াই ব্যক্তিগত ইমেজে বিজয়ী হন দলের আরেক বিদ্রোহী প্রার্থী মো. আমানুল্লাহ। অন্যদিকে জাসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও সেখানে জাসদ একাংশের সাধারণ সম্পাদক স্থানীয় এমপি নাজমুল হক প্রধানের প্রার্থী এরমান আমিনও পরাজিত হয়েছেন। জামালপুরে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহম্মেদ চৌধুরী ছিলেন জনপ্রিয় প্রার্থী। তার পরিবর্তে সমর্থন পান এইচ আর জাহিদ আনোয়ার। জেলা আওয়ামী লীগ এবং জনপ্রতিনিধিরা তার বিপক্ষে অবস্থান নেন। ফলত বিদ্রোহী হলেও বিপুল ভোটের ব্যবধানে দলীয় প্রার্থীকে পরাজিত করেন ফারুক আহম্মেদ।

চুয়াডাঙ্গায় আওয়ামী লীগের দুই এমপি আলী আজগর টগর ও সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দারের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। তার প্রভাব পড়েছে এবারের জেলা পরিষদ নির্বাচনেও। এ জেলায় দলীয় সমর্থন পান দামুড়হুদা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান মনজু। দলের নির্দেশনা মোতাবেক সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার মনজুকে সমর্থন দেন। অন্যদিকে আলী আজগর টগর তার প্রভাব ধরে রাখতে শেখ শামসুল খোকনকে বিদ্রোহী হিসেবে বেছে নেন। দুই এমপিই শেষ পর্যন্ত নিজ নিজ প্রার্থীকে বিজয়ী করতে চেষ্টা চালান। এ জেলায় বিএনপি-জামায়াতের বেশকিছু ভোটার থাকায় বিদ্রোহী প্রার্থীই বিজয়ী হন।

নড়াইলে দলীয় প্রার্থীর হারের পেছনে কাজ করেছে নড়াইল-১ আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট সুবাষ চন্দ্র বোসের বিরোধিতা। এ ছাড়া জেলার অনেক নেতাই ছিলেন দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে। জেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন পান আইয়ুব আলী। সেখানে নড়াইল-১ আসনের এমপি কবিরুল হক মুক্তি দাঁড় করান সোহরাব হোসেন বিশ্বাসকে। এই এমপি বিগত পৌরসভা নির্বাচনের সময়ও দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে কাজ করেছেন বলে দলের হাইকমান্ডের কাছে অভিযোগ রয়েছে।

চাঁদপুরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এম আবু ওসমান চৌধুরী। স্থানীয় ভোটার তালিকায় তার নাম না থাকায় তিনি এবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি। ফলে তিনজন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে ওসমান গনি পাটোয়ারীকে সমর্থন দেন জেলার এমপি ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম। আরেক প্রার্থী সাবেক ছাত্রনেতা নুরুল আমিন রুহুলকে সমর্থন দেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সাবেক মন্ত্রী দীপু মনি, শামসুল হক ভুইয়া এমপিসহ চার এমপি। এখানে ওসমান গনি পাটোয়ারী বিজয়ী হন। কয়েকজন এমপি এক হয়েও তাদের প্রার্থীকে জেতাতে পারলেন না। একই ঘটনা ঘটেছে সুনামগঞ্জেও। এ জেলায় দলীয় সমর্থন পান সাবেক জেলা পরিষদ প্রশাসক ও জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এনামুল কবির ইমন। তার পক্ষে একাট্টা হয়েছিলেন সাবেক মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, দুই এমপি মুহিবুর রহমান মানিক ও মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। কিন্তু নিজ নিজ এলাকায় ভরাডুবি হয়েছে তাদের সমর্থিত প্রার্থী ইমনের। এখানে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের সমর্থনবঞ্চিত নুরুল হুদা মুকুট। নির্বাচনে তার সঙ্গে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আলহাজ মতিউর রহমান, জাতীয় কমিটির সদস্য পৌর মেয়র আয়ুব বখত জগলুলসহ দলের প্রভাবশালী নেতারা। এ ছাড়া বিগত ইউপি নির্বাচনে ইমনের বিরুদ্ধে আনা দলীয় ‘মনোনয়ন বাণিজ্য’ তার ভরাডুবির জন্য দায়ী বলে দাবি মুকুট সমর্থকদের।

মেহেরপুর আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরেই বহুধাবিভক্ত। দলীয় প্রার্থী জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক মিয়াজানের পক্ষে ছিলেন মেহেরপুর-২ আসনের এমপি মকবুল হোসেন। মেহেরপুর-১ আসনের এমপি ফরহাদ হোসেন দোদুল সমর্থন দেন বিদ্রোহী প্রার্থী জিয়াউদ্দিনকে। এ ছাড়া আরও দুজন বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। দুই এমপির দুই মেরুতে থাকায় তারা দুজনই পরাজিত হয়েছেন। এর মধ্যে আরেক বিদ্রোহী প্রার্থী গোলাম রসুল জয়ী হয়েছেন। পরাজিত হয়েছেন সাবেক প্রশাসক মিয়াজান।

অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে গাইবান্ধা জেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী জেলা সভাপতি সৈয়দ শামস-উল-আলমের পরাজয় হয়েছে। বিদ্রোহী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক মণ্ডল। ভোট ভাগাভাগি হওয়ার কারণে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীর পরাজয় ঘটে। স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউর রহমান সরকার ৩৮৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। এ ছাড়া রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী মাহবুব জামান ৩২৭ ভোটে ধরাশায়ী হয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থী মোহাম্মদ আলী সরকারের কাছে। সেখানে মোট ভোটার ১ হাজার ১৭১ জন। বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত ভোটার ৫ শতাধিক। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, এই ভোটগুলোর প্রায় সবই পেয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থী।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর