শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

প্রশ্নফাঁসের যত কথা

আকতারুজ্জামান

বিভিন্ন পরীক্ষাকে ঘিরে ২০১৬ সালের বছরজুড়েই আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে ছিল প্রশ্ন ফাঁস। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রাথমিক সমাপনী, জুনিয়র সার্টিফিকেট, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকসহ বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা, ব্যাংকে নিয়োগসহ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা ও বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের গুজব নিয়ে ছিল    সরব। বাদ যায়নি বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পরীক্ষার আগেই চলে যায় ভর্তিচ্ছুদের হাতে। শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। এর বাইরে শিক্ষার্থীদের পাস, জিপিএ-৫ প্রাপ্তি ও শিক্ষার মানের চিত্র নিয়ে তৈরি করা একটি ভিডিওচিত্রেও দেশজুড়ে হয়েছে তোলপাড়। শিক্ষার মান নিয়ে হয়েছে সমালোচনা। আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি বাক্যটির ইংরেজি অনুবাদ মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পাওয়া ১৩ শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করা হলে কেউই এর উত্তর দিতে পারেনি। কেউ বা বলেছে ‘আই অ্যাম জিপিএ ফাইভ’। ঘটনাপ্রবাহ অনুসারে, পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকে এ বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হয়। পরীক্ষার আগে ও পরীক্ষা চলাকালীন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সময় প্রশ্ন ফাঁসের গুজব ছিল তুঙ্গে। ৩ এপ্রিল থেকে শুরু হয় উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির পরীক্ষা। এ পরীক্ষার বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হয় বলে অভিযোগ ছিল। বিভিন্ন গণমাধ্যমে পরীক্ষার প্রশ্ন ও ফাঁস হওয়া প্রশ্নের স্ক্রিনশর্ট দিয়ে খবরও প্রকাশিত হয়। জীববিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্রের বহুনির্বাচনী ও তত্ত্বীয় প্রশ্ন হুবহু পাওয়া যায় পরীক্ষার এক ঘণ্টা আগেই ফেসবুকে। আহমেদ নিলয় নামে এক জালিয়াত এই প্রশ্ন ফাঁস করে দেন। জীববিজ্ঞান প্রথম পত্রের প্রশ্ন ফাঁস হয় বলেও অভিযোগ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের ‘ঘ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা আগেই। এ নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করে। একই ইউনিটে এক ছাত্রী ৯ লাখ টাকার বিনিময়ে মেধা তালিকায় ৫ম স্থান অধিকার করে বলে অভিযোগ ওঠে। অথচ ওই ছাত্রী ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ১২০ নম্বরের মধ্যে মাত্র ১৮ এবং ‘চ’ ইউনিটে ১২০ এর মধ্যে মাত্র ২৪ নম্বর পেয়ে উভয় পরীক্ষায়ই ফেল করে। পরে ভর্তির জন্য সাক্ষাৎকার দিতে এলে পুনরায় পরীক্ষা নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এই পরীক্ষায় ফেল করে ওই ছাত্রী। ওই ছাত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভর্তির অযোগ্য ঘোষণা করে। ঘ ইউনিটে প্রশ্ন ফাঁসসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ এনে পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার দাবি জানায় ছাত্র ইউনিয়ন। এ দাবিতে ঢাবি উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপিও দিয়েছে সংগঠনটি। এ ছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁস ও অনিয়মের অভিযোগ করে এই ইউনিটের ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত করে পুনরায় পরীক্ষা নিতে আইনি নোটিস পাঠানো হয়। ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী রাকিবুল হাসানের পক্ষে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী আ স ম সায়েম আলী ডাকযোগে এ নোটিস পাঠান। নোটিসে বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬-১৭ সেশনের ভর্তি পরীক্ষায় ‘ঘ’ ইউনিটে অনিয়ম করে টাকার বিনিময়ে মেধা তালিকায় স্থান দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ মেলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও (জবি)। ডি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা শুরুর আগেই একটি কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খুলে সেখান থেকে দুটি প্রশ্ন সরিয়ে ফেলে কে বা কারা। জবির এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে এক শিক্ষকসহ দুজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। পরীক্ষা শুরুর আগেই ভর্তিচ্ছুদের মোবাইল নিয়ে পড়তে দেখা গেছে। পরীক্ষা শুরুর পর কেন্দ্রের গেট বন্ধ করে দিলে ভর্তিচ্ছুরা গেট টপকেও পরীক্ষা দিতে ঢুকেছে। ভর্তি পরীক্ষায় দায়িত্বে অবহেলা ও নৈতিকতাবিরোধী কাজের অভিযোগে ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক দেওয়ান বদরুল হাসান ও কর্মচারী এমদাদুল হককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসা শিক্ষা অনুষদভুক্ত সি-৩ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নে সঠিক সব উত্তরগুলো ঝাপসা করে দেওয়া ছিল। অভিযোগ ওঠে, সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মকর্তারা অনৈতিকভাবে মোটা অংকের অর্থ লেনদেন করে নিজেদের প্রার্থীকে ভর্তি করাতে এ অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করতে চেয়েছিলেন। বিষয়টি সারা দেশে হৈচৈ সৃষ্টি করেছিল। ভর্তি পরীক্ষায় প্রশাসনের এমন অসদুপায়ের বিষয়টি জানাজানি হলে পরে এ পরীক্ষা বাতিল করা হয়। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দাবি করেছে, ‘এটি প্রিন্টিং মিসটেক ছিল’। এ ছাড়া প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের গুজব ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছিল জালিয়াত চক্রের সরব প্রচারণা। বছরের শুরুর দিকে একটি বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেলে প্রচারিত একটি সংবাদ আলোড়নের সৃষ্টি করে সারা দেশে। দেশে পাসের হার, জিপিএ-৫ ও শিক্ষার মানের চিত্র নিয়েই মাধ্যমিকে সর্বোচ্চ ফলাফল করা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এ প্রতিবেদন তৈরি করে চ্যানেলটি। প্রতিবেদনে দেখানো হয়, জিপিএ ও এসএসসির পূর্ণ রূপ বলতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। ‘আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি’ বাক্যটির ইংরেজি অনুবাদ তেরোজন জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করা হলে কেউই এর উত্তর দিতে পারেনি। কেউ বা বলছে, ‘আই অ্যাম জিপিএ ফাইভ’। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বুদ্ধিজীবী দিবস কবে এমন প্রশ্ন করলেও সর্বোচ্চ জিপিএধারীরা ভুল উত্তর দেয়। প্রতিবেদনে আরও দেখানো হয়, জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার কোথায় অবস্থিত এমন প্রশ্নের জবাবও দিতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। এ প্রতিবেদন প্রকাশ পাওয়ার পর শিক্ষার মান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। শিক্ষাব্যবস্থায় পাস, জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সঙ্গে যে শিক্ষার মানে বিশাল ফারাক এটি মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। তবে টেলিভিশন চ্যানেলটির এ প্রতিবেদন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তৈরি এমন মন্তব্যও করেছেন অনেকেই।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর